যাকাত একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত যাকাত একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত
জুমার খুতবা
*************
৩য় জুমা, রমাদ্বান ১৪৩৯ হি: মে, ২০১৮ সা
যাকাত একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত:
************************************
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
(বিএ. অনার্স, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর। এম.এ. এম.ফিল. কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর। পিএইচ.ডি গবেষক,চ.বি.)
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ. খতীব, মুসাফির খানা জামে মসজিদ, নন্দন কানন, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين, أما بعد!
যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। যাকাত- ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিধান। ঈমান ও সালাতের পরেই যাকাতের স্থান। কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’আলা যখনই নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন,[ وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ [البقرة:৪৩ “আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩) [দেখতে পারেন ২:৪৩, ২:৮৩, ২:১১০, ২৪:৫৬, ৫৮:১৩ ইত্যাদি আয়াতগুলো।]
কুরআন-হাদিস ও মুসলিমের ইজমা দ্বারা এর ফরযিয়্যাত প্রমাণিত। তাই যাকাত ইসলামের অন্যতম অপরিহার্য ফরয দায়িত্ব বলে প্রমাণিত; যার অস্বীকারকারী বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্লকারী কাফির বলে গণ্য; ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত-মুরতাদ। তাকে তওবার জন্য বলা হবে, যদি তওবা করে গ্রহণ করা হবে, অন্যথায় তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হবে। আর অনাদায়কারী ফাসিক এবং কঠিন শাস্তির যোগ্য। এই যাকাত ফরয করা হয় ২য় হিজরীতে। এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত, পক্ষান্তরে যাকাতের সম্পর্ক অর্থের সাথে এবং হজ্বের সম্পর্ক দেহ ও অর্থের সাথে। আর যাকাতের ব্যাপারে যে কৃপণতা করল অথবা কম আদায় করল সে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত ও আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ بِمَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ هُوَ خَيۡرٗا لَّهُمۖ بَلۡ هُوَ شَرّٞ لَّهُمۡۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِۦ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ وَلِلَّهِ مِيرَٰثُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ )سورة آل عمران:১৮০(
“আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার একমাত্র আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত”। (সূরা আলে-ইমরান:১৮০)
মহান আল্লাহ পৃথিবীর মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য যাকাত ফরয করেছেন। পবিত্র কুরআনে ৩২ জায়গায় যাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। যাকাত না দিলে সম্পদ শুধু ধনীদের কাছে জমা হয়। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং ধনীরা জোঁকের মত সমাজের রক্ত শোষণ করে নিজে বড় হয়, আর সমাজকে রক্তহীন করে দেয়। তাই পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাসীসে যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
যাকাতের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:
++++++++++++++++++++++
‘যাকাত’ শাব্দিকভাবে ‘বৃদ্ধি পাওয়া’ ‘পবিত্রতা লাভ করা’ ‘প্রাচুর্য বা বরকতমন্ডিত হওয়া’ ইত্যাদিকে বুঝায়। যাকাত দ্বারা যাকাতদাতার সম্পদের যেমন পবিত্রতা ও বৃদ্ধি আসে তেমনি আত্মারও পরিশুদ্ধতা লাভ হয় বিধায় যাকাতকে যাকাত বলা হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআনে বলা হয়েছে-خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا ‘হে মাহবুব! তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন, ‘যা দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করবেন। [সূরা তাওবা, আয়াত-১০৩] يَمْحَقُ اللهُ الرِّبوا وَيُرْبِىْ الصَّدَقَاتِ “আল্লাহ তা’আলা ধ্বংস করেন সুদকে আর (উভয় জগতে) বর্ধিত করেন (সাদক্বা, যাকাত ইত্যাদি) দানকে”। [সূরা বাকারা আয়াত-২৭৬] وَمَآ اَنْفَقْتُمْ مِنْ شَئٍ فَهُوَ يُخْلِفُه “আর যা কিছু তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো, তিনি তার পরিবর্তে আরো অধিক দেবেন।” [সূরা সাবা আয়াত- ৩৯]
পরিভাষায়:
=======
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদের একাংশ মুসলিম দরিদ্র ব্যক্তিকে বিনা শর্তে ও স্বার্থে প্রদান করে মালিক বানিয়ে দেয়ার নাম ‘যাকাত’। হিজরতের পর দ্বিতীয় সালে যাকাত ফরয ও সবিস্তারে প্রবর্তিত হয়। (সুত্রঃ গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব)
অথচ এ বিধানটাকে আমরা কতই না অবহেলা করি! কুরআন শরীফের একেবারে শুরুর দিকে, সূরা বাক্বারায় হেদায়াতপ্রাপ্ত মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন,[ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ [البقرة: ৩
“যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।” (বাক্বরা-০৩)। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন ও হেদায়াতের পূর্ণতায় পৌঁছতে যাকাত প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। যে ব্যক্তি যাকাত ফরয হওয়ার পরও তা আদায় করে না, তার পক্ষে পূর্ণ হেদায়াত লাভ করা কখনো সম্ভব নয়। যাকাত প্রদান করলে যেমন পাচ্ছে হেদায়াত ও আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য, ঠিক তেমনিভাবে, না আদায় করলে প্রস্তুত থাকছে ভয়ানক শাস্তি। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
۞ يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنوا إِنَّ كَثيرًا مِنَ الأَحبارِ وَالرُّهبانِ لَيَأكُلونَ أَموالَ النّاسِ بِالباطِلِ وَيَصُدّونَ عَن سَبيلِ اللَّـهِ وَالَّذينَ يَكنِزونَ الذَّهَبَ وَالفِضَّةَ وَلا يُنفِقونَها في سَبيلِ اللَّـهِ فَبَشِّرهُم بِعَذابٍ أَليمٍ ۞ يَومَ يُحمى عَلَيها في نارِ جَهَنَّمَ فَتُكوى بِها جِباهُهُم وَجُنوبُهُم وَظُهورُهُم هـذا ما كَنَزتُم لِأَنفُسِكُم فَذوقوا ما كُنتُم تَكنِزونَ ۞ ﴿التوبه: ৩৪-৩৫﴾
“হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো তা যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে
আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। (আত তাওবা-৩৪-৩৫)
পবিত্র কোরআনের ত্রিশতম পারার সূরা হুমাযা পুরোটাই যাকাত প্রদান না করার শাস্তির আলোচনায় উৎসর্গিত। দেখুন,
﴿ بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ﴾ وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ﴿١﴾ الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ ﴿٢﴾ يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ ﴿٣﴾ كَلَّا لَيُنبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ ﴿٤﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ ﴿٥﴾ نَارُ اللَّـهِ الْمُوقَدَةُ ﴿٦﴾ الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ ﴿٧﴾ إِنَّهَا عَلَيْهِم مُّؤْصَدَةٌ ﴿٨﴾ فِي عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ ﴿٩﴾
“শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। “প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ, যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে! কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কি? এটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে, লম্বা লম্বা খুঁটিতে।” (সূরা আল হুমাযাহ, আয়াত: ১-৯)
বস্তুত, সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানাকে ইসলাম স্বীকার করে নিলেও, এ সুযোগে যেন অশুভ পুঁজিতন্ত্র জন্ম লাভ না করতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ রোধে তাই যাকাতকে গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি।
ইসলাম মনে করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বাদ দেয়ার পর কারো যদি ৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা সমমূল্যের সম্পদ এক বৎসর কাল পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তাহলে সে সম্পদশালী। এ ধরনের সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে রাষ্ট্রের অন্যান্য অভাবী মানুষদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য ঐ সঞ্চিত সম্পদের শতকরা ২.৫ টাকা যাকাত প্রদানের দাবি জানায় ইসলাম।
যাকাত আদায়ের বিবিধ হিকমত ও উপকারিতা নিম্নরূপ:
==================================
যাকাত ফরয হওয়ার পেছনে অসংখ্য হিকমত রয়েছে। যেমন- সম্পদ উপার্জনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। আর এ তারতম্য কমিয়ে ধনী-গরিবের মাঝে ভারসাম্য আনার জন্য মহান আল্লাহ যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ দেখা যায় কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অর্থ-কড়ি ও ভোগ-বিলাসে মত্ত আছে এবং প্রাচুর্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে, আর কিছু লোক দারিদ্র সীমার একেবারে নীচে অবস্থান করছে। মানবেতর জীবন যাপন করছে। আল্লাহ এ ব্যবধান দূর করার জন্যই তাদের সম্পত্তিতে যাকাত ফরয করেছেন। যাতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমে যায় এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়। অন্যথায় দেশে বা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, ফিতনা-ফাসাদ ও হত্যা-লুণ্ঠন ছড়িয়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতি ।
এছাড়া যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, যাকাত মানুষকে কৃপণতা থেকে বিরত রাখে। মানুষকে পরোপকারী, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে সাহায্য করে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুমলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভাবমর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে এবং আত্মমার্যাদা ও সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। তাদের মাঝে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যরে সেতুবন্ধন রচিত হয়। দূর হয় পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। কারণ গরিবরা যখন ধনীদের সম্পদ দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের সহানুভূতি লাভ করে, তখন তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হয়। যাকাত একটি সমাজ বা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও গতিশীলতাকে স্বাভাবিক রাখার নিশ্চয়তা বিধান করে। যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাই বর্তমান অর্থব্যবস্থার সব প্রকার ত্রæটি-বিচ্যুতি ও নানাবিধ সমস্যার যুৎসই সমাধান। তাই যাকাত আদায়ের কিছু উপকারিতা নিম্নে দেয়া হলো:
১. গরীবের প্রয়োজন পূর্ণ করা; অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটন করা; সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতাকে শেষ করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা।
২. মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধি করা; দারিদ্র বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ সবরকম অভাবজনিত অপরাধের মূলোৎপাটন করা। গরীব-ধনীর মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা।
৪. সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি লাভ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ ، “যাকাতের সম্পদ কমে না”( )।অর্থাৎ, হয়ত দৃশ্যতঃ সম্পদের পরিমাণ কমবে, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এই স্বল্প সম্পদের মাঝেই বেশি সম্পদের কার্যকারী ক্ষমতা দিয়ে দিবেন।
৫. সম্পদের উপকারিতার পরিধি বৃদ্ধি করা। কেননা সম্পদ যখন যাকাতের মাধ্যমে অভাবীদের মাঝে বণ্টিত হয়, তখন এর উপকারিতার পরিধি বিস্তৃত হয়। আর যখন তা ধনীর পকেটে কুক্ষিগত থাকে, তখন এর উপকারিতার পরিধিও সঙ্কীর্ণ হয়।
৬. যাকাত প্রদানকারীর দান ও দয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া; অন্তরে অভাবীর প্রতি মায়া-মমতা সৃষ্টি হওয়া।
৭. কৃপণতার ন্যায় অসৎ গুণ থেকে নিজেকে পবিত্র করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (سورة التوبة -১০৩﴾ “তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন; যেন আপনি সেগুলোকে এর মাধ্যমে পবিত্র ও বরকতময় করতে পারেন”।(আত তাওবা-১০৩)
৮. সর্বোপরি আল্লাহর বিধান পালন করার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে তাঁর নৈকট্য লাভ করা। তাই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এবং দ্বীনি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যাকাতের কোন বিকল্প নেই।
যাকাত পরিশোধ না করার পরিণাম:
=====================
যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে: আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّـهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّـهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ﴿ آل عمران- ١٨٠﴾
“আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত¡াধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।(আ-ল ইমরান-১৮০) অন্যত্র ইরশাদ করেন-
۞ وَالَّذينَ يَكنِزونَ الذَّهَبَ وَالفِضَّةَ وَلا يُنفِقونَها في سَبيلِ اللَّـهِ فَبَشِّرهُم بِعَذابٍ أَليمٍ ۞ يَومَ يُحمى عَلَيها في نارِ جَهَنَّمَ فَتُكوى بِها جِباهُهُم وَجُنوبُهُم وَظُهورُهُم هـذا ما كَنَزتُم لِأَنفُسِكُم فَذوقوا ما كُنتُم تَكنِزونَ ۞ ﴿التوبه ৩৪-৩৫﴾
“আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। (আত তাওবা-৩৪-৩৫)
আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحَ مِنْ نَارٍ فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ فَيَرَى سَبِيلَهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ
“যে কোন স্বর্ণ বা রুপার মালিক যদি আপন সম্পদের যাকাত আদায় না করে, তার এ সম্পদকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে কিয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দেয়া হবে। আর যখনই তা ঠাÐা হবে সাথে সাথে আগুনে পুণরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে যে দিনটি হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অত:পর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে।’ ( )
আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ -رضي الله عنه- قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: “مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ -يَعْنِي شِدْقَيْهِ- ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ. ثُمَّ تَلاَ.: وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (آل عمران: ১৮০(
“আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’( )
যাকাত গরিবের প্রতি কোন করুণা নয় বরং তার হক- যা ধনী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কারণে আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, وَاللهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالًا كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ، ‘যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একটি উটের রশিও যাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি তা দিতে অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ ( ) তাঁর এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত,আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ:্র مَا مِنْ رَجُلٍ لاَ يُؤَدِّى زَكَاةَ مَالِهِ إِلاَّ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ يَفِرُّ مِنْهُ وَهُوَ يَتْبَعُهُ حَتَّى يُطَوَّقَهُ فِى عُنُقِهِ গ্ধ. ثُمَّ قَرَأَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم }وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ{
“কোন ব্যক্তি যদি তার ধনসম্পদের যাকাত না দেয় তবে ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন অজগর সাপের আকার ধারণ করে তার গলদেশ বেষ্টন করবে”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারপর তিলাওয়াত করলেন, “আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।” ( )
যেসব সম্পত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয়:
=======================
প্রথমত. জমিনে উৎপাদিত ফসল, ফল ও বীজের ওপর যাকাত ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ(الأنعام-১৪১) “তোমরা জমিনের ফসল খাও যখন ফসল ফলে, আর ফসল কাটার সময় ফসলের হক্ব আদায় কর। তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনাম: ১৪১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “বৃষ্টির পানি অথবা সমুদ্রের পানি দ্বারা উৎপাদিত ফসলে দশ ভাগের এক ভাগ আর সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত জমিনের ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে।” তবে হাদিসের ভাষায় ফসলের পরিমাণ পাঁচ ওছাক হতে হবে।
দ্বিতীয়. গবাদি পশু যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির ওপর যাকাত ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ ﴿৫﴾ وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ ﴿৬﴾ “এবং গৃহপালিত পশু যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে রয়েছে শীত বস্ত্রের উপকরণ এবং মানুষের জন্য উপকার।” (সূরা নাহাল : ৫-৬)
এসব জীব-জন্তুর যাকাত ওয়াজিব হবে যখন মুক্ত বিচরণকারী এবং নিসাব পরিমাণ হয়। এসবের মধ্যে উটের নিসাব হল কমপক্ষে পাঁচটা আর গরু ত্রিশটি এবং ছাগল চল্লিশটি। কিন্তু মুক্ত বিচরণকারী না হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে।
তৃতীয়. স্বর্ণ, রৌপ্যেও যাকাত ওয়াজিব। স্বর্ণ ও রৌপ্য যে কোন ধরনের হোক না কেন এর যাকাত ওয়াজিব। তবে স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্যের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা হতে হবে।
চতুর্থ. ব্যবসার মালামালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব। জমি, গবাদি পশু, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সবকিছুতেই যাকাত ওয়াজিব যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং মালিককে বছর শেষে হিসাব করে এসবের যাকাত পরিশোধ করতে হবে।
যাকাত বন্টনের নির্ধারিত ৮টি খাতের বিবরণ:
============================
যাকাতের সম্পদ সঠিকভাবে বন্টন করার উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই কারণে আল্লাহপাক নিজেই যাকাত ব্যয় বন্টনের খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (التوبة-৬০)
যাকাত কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান।আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (আল কুরআন, আত তাওবা:৬০)। এ খাতের বাইরে অন্য কোন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। নিম্নে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত উলেস্নখিত ৮টি খাতের বর্ণনা দেয়া হলো।
প্রথম খাতঃ
ফকীর- ফকীর হলো সেই ব্যক্তি যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। যে ব্যক্তি রিক্তহস্ত, অভাব মেটানোর যোগ্য সম্পদ নেই, ভিক্ষুক হোক বা না হোক, এরাই ফকীর। যে সকল স্বল্প সামর্থের দরিদ্র মুসলমান যথাসাধ্য চেষ্টা করা সত্তে¡ও বা দৈহিক অক্ষমতাহেতু প্রাত্যহিক ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে না, তারাই ফকীর। কারও মতে যার কাছে একবেলা বা একদিনের খাবার আছে সে ফকীর।
দ্বিতীয় খাতঃ
মিসকীন- মিসকীন সেই ব্যক্তি যার কিছুই নেই, যার কাছে একবেলা খাবারও নেই। যে সব লোকের অবস্থা এমন খারাপ যে, পরের নিকট সওয়াল করতে বাধ্য হয়, নিজের পেটের আহারও যারা যোগাতে পারে না, তারা মিসকীন। মিসকীন হলো যার কিছুই নেই, সুতরাং যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ নেই, তাকে যাকাত দেয়া যাবে এবং সেও নিতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ফকীর বা মিসকীন যাকেই যাকাত দেয়া হবে, সে যেন মুসলমান হয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়।
তৃতীয় খাতঃ
আমেলীন- ইসলামী সরকারের পক্ষে লোকদের কাছ থেকে যাকাত, উশর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টনের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। এদের পারিশ্রমিক যাকাতের খাত থেকেই আদায় করা যাবে। কুরআনে বর্ণিত আটটি খাতের মধ্যে এ একটি খাতই এমন, যেখানে সংগৃহীত যাকাতের অর্থ থেকেই পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এ খাতের বৈশিষ্ট্য হলো এতে ফকীর বা মিসকীন হওয়া শর্ত নয়। পক্ষান্তরে, অবশিষ্ট ৫টি খাতে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থতা দূরীকরণে যাকাত আদায় শর্ত।
চতুর্থ খাতঃ
মুয়াল্লাফাতুল কুলুব (চিত্ত জয় করার জন্য)- নতুন মুসলিম যার ঈমান এখনও পরিপক্ক হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অমুসলিম। যাদের চিত্ত (দ্বীন ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করে) আকর্ষণ ও উৎসাহিত করণ আবশ্যকীয় মনে করে যাকাত দান করা হয়, যাতে তাদের ঈমান পরিপক্ক হয়। এ খাতের আওতায় দুঃস্থ নও মুসলিম ব্যক্তিদের যাকাত প্রদানের ব্যাপারে ফকিহগণ অভিমত প্রদান করেছেন।
পঞ্চম খাতঃ
ক্রীতদাস/বন্দী মুক্তি- এ খাতে ক্রীতদাস-দাসী/বন্দী মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। অন্যায়ভাবে কোন নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দী হলে তাকেও মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
ষষ্ঠ খাতঃ
ঋণগ্রস্থ- এ ধরণের ব্যক্তিকে তার ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত দেয়ার শর্ত হচ্ছে- সেই ঋণগ্রস্থের কাছে ঋণ পরিশোধ পরিমাণ সম্পদ না থাকা। আবার কোন ইমাম এ শর্তারোপও করেছেন যে, সে ঋণ যেন কোন অবৈধ কাজের জন্য- যেমন মদ কিংবা না- জায়েয প্রথা অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য ব্যয় না করে।
সপ্তম খাতঃ
আল্লাহর পথে- সম্বলহীন মুজাহিদের যুদ্ধাস্ত্র/সরঞ্জাম উপকরণ সংগ্রহ এবং নিঃস্ব ও অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থীকে এ খাত থেকে যাকাত প্রদান করা যাবে। এ ছাড়াও ইসলামের মাহাত্ম ও গৌরব প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে যারা জীবিকা অর্জনের অবসর পান না এবং যে আলিমগণ দ্বীনি শিক্ষাদানের কাজে ব্যাপৃত থাকায় জীবিকা অর্জনের অবসর পান না। তারা অসচ্ছল হলে সর্বসম্মতভাবে তাদেরকেও যাকাত দেয়া যাবে।
অষ্টম খাতঃ
অসহায় মুসাফির- যে সমস্ত মুসাফির অর্থ কষ্টে নিপতিত তাদেরকে মৌলিক প্রয়োজন পুরণ হওয়ার মত এবং বাড়ী ফিরে আসতে পারে এমন পরিমাণ অর্থ যাকাত থেকে প্রদান করা যায়।
যাকাত কখন ফরয হয়:
===============
৭.৫ ভরি স্বর্ণ বা ৫২.৫ ভরি রূপা অথবা সমমূল্যের নিত্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে। এ হিসাবটাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নেসাব’ বলে। অতএব, কারো যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী: ১ ভরি রূপা= ১০০০ টাকা: ৫২.৫ ভরি রূপা= ৫২,৫০০ টাকা, অতএব কেউ ৫২,৫০০ টাকার মালিক হলে এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে, তার উপর যাকাত ফরয হবে। (৫২,৫০০ টাকায় শতকরা ২.৫ টাকা হিসেবে মাত্র ১৩১২.৫ টাকা যাকাত আসে।
কোন কোন সম্পদে যাকাত আসে:
=====================
১. নগদ টাকা-পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স, বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস ২. সোনা-রূপা; অর্নামেন্ট, বার যা-ই হোক; তা নিত্যব্যবহার্য হলেও। ৩. ব্যবসার সম্পদ; যা ব্যবসার উদ্দেশে ক্রয়কৃত; কিংবা ব্যবহারের উদ্দেশে ক্রয়ের পর বিক্রয়কৃত। ব্যবসার কাঁচামাল, উৎপাদিত বস্তু, বা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা বস্তু। শেয়ারও এ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। ৪. অন্যান্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদ।
মাসআলাঃ
———-
নিছক ভোগ করার অনুমতি দিলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন ফক্বীরকে যাকাতের নিয়্যতে খাবার খাওয়ানো হলো। যাকাত আদায় হবে না। কারণ এর দ্বারা মালিক বানিয়ে দেয়া হলো না। তবে যদি খাবার দিয়ে দেয়া হয় এবং তার ইচ্ছে হলে খাবে বা নিয়ে যাবে তাহলে আদায় হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ
———-
মালিক করার জন্য এটাও প্রয়োজন যে, এমন লোককে যাকাত দেবে, যে গ্রহণ করতে জানে। অর্থাৎ এমন কাউকে যেন দেয়া না হয়, যে ফেলে দেবে বা ধোঁকা খাবে। এমনটি হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন ছোট শিশু বা পাগলকে যাকাত দিলে আদায় হবে না। যে শিশুর গ্রহণ করার মত জ্ঞান হয়নি তার পক্ষে তার গরীব পিতা গ্রহণ করতে পারে বা ওই শিশুর যিম্মাদার বা ওই শিশুর লালন-পালনকারী গ্রহণ করতে পারে। [দুর্রুল মুখতার]
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত: যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ভরি=১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত যে কোন বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত ফরয।
নগদ অর্থের যাকাত:
================
নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোষ্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি একাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোষ্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কীম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতি বছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির উপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ সাওয়াবের নিয়ত না করে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার উপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ঐ মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে।
যাকাত বহির্ভুত সম্পদ:
==============
জমি, বাড়ী-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ী, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ী, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহ-পালিত পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির যাকাত হয় না। ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত হয় না। শস্য ও গবাদি পশুর যাকাত পরিশোধ করার পর ঐ শস্য বা গবাদি পশু বিক্রি করে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ঐ প্রাপ্ত অর্থের উপর একই বছরে যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার যাকাত হয় না।
যাদের যাকাত দেয়া যাবেনা:
=================
ধনী ব্যক্তির জন্য যাকাত খাওয়া বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। আপন দরিদ্র পিতা-মাতা, দাদা-দাদী তথা ঊর্ধ্বস্থ সকল নারী-পুরুষ, অনুরূপ ভরণ- পোষণে নির্ভরশীল পুত্র-কন্যা এবং স্বামী স্ত্রীকে যাকাত প্রদান করা জায়েয নাই। যাকাত বহির্ভুত সম্পদের দ্বারা তাহাদের ভরণ-পোষণ করা ওয়াজিব।
অনুরূপ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা সাহায্য করা জায়েয নয়। একমাত ঐচ্ছিক দানের অর্থ দ্বারাই তাদের খেদমত করা জরুরী। মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা নিষেধ। সাধারণ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাও জায়েয নয়। তবে আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘর-বাড়ী নির্মাণ করে দেয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে যাকাত পরিশোধ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। সুতরাং যাকাতের অর্থে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও জায়েয নয়। যাকাত দেওয়া যেমন শরীয়তের বিধান, অনুরূপ যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকেই যাকাত দেওয়া শরীয়তের বিধান। সঠিক পাত্রে যাকাত প্রদান না করলে যাকাত পরিশোধ হবে না।
وصلى الله وسلم على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه اجمعين.
No comments