ইসলামে মদ হারাম কেন?

ইসলামে মদ নিষিদ্ধ কেন?
════❋?❋════✍ ইমরান বিন বদরী ≪
নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লী আ’লা রাসুলুহীল কারীম আম্মা বা’দ। প্রশ্নটি খুবী সহজ কিন্তু এর ব্যাখা অনেক ব্যাপক। আজ আভিজাত্য আতিথেয়তা ভেবে সমাজের একটি অংশ এ হারাম হওয়া পানীয়কে স্বতঃসস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করছে। অথচ যেটি ১৪০০ বছর আগে আমার রাসুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। বর্তমানে অনেক মুসলমান ভাইদের দেখা যায় মদ’কে হারাম জেনে মদ্যপান না করলেও মদের ব্যবসা কিন্তু ঠিকি করে যাচ্ছেন। বিষয়টি ডাক্তারের নিষেধ মানতে গিয়ে চিনি না খেয়ে রসগোল্লা খাওয়ার মতই। মদ পানকরা ইসলামের প্রাথমিক যুগে নিষিদ্ধ না থাকলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এটাকে পর্যায়ক্রমে আল্লাহ তায়ালা নিষিদ্ধ করে উম্মতে মুহাম্মদিকে রক্ষা করেছেন। আরবি الْخَمْرُ শব্দের অর্থ মদ।মদ প্রস্তুতকরণে আঙুরের রস সহ নানান উপকরণ ব্যবহার করা হলেও আধুনিকতার যুগে বিভিন্ন রাসায়নিক সামগ্রীও ব্যবহৃত হয় মদ প্রস্তুতকরণে।তবে সমস্ত মদ তৈরীর একটাই উদ্দেশ্য কেবল মানুষের বিবেকবোধকে লোপ পাওয়ানো। খলিফাতুল মুসলেমীন হজরত ওমরে ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খুবী সুন্দর করে বলেছেন যে, الْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلَ ‘মদ তাই,যা মানুষের বিবেককে আচ্ছন্ন করে’।(মুত্তাফাকুন আলাইহি /মিশকাত ৩৬৩৫)।

?বস্তুত মদ এর কারণে মানবজীবনে যত সমস্যার সৃষ্টি হয় তা অন্যকোন ক্ষেত্রে লক্ষণীয় নয়। মানুষ স্বভাবগত নেশার প্রতি বেশী ঝোঁকে বিধায় মদের নেশায় মত্ত হয়ে ইসলামের হুকুম আহকামকে অবজ্ঞা বা গাফিলতি করা থেকে মুক্ত করতে মদ কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমস্ত অপকর্মের সাথে ব্যক্তি পরিবার এবং সমাজকে ধ্বংস করার জন্য মদ নামের পানীয়জলই যথেষ্ট। আসুন এ ব্যপারে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা কি হুকুম করেছেন দেখি,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَقْرَبُوا الصَّلاَةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ
অর্থাৎ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার’ (সূরা নিসা ৪৩)।
উপরোক্ত আয়াতটি একদিন এক সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ীতে দাওয়াত শেষে মদ্যপান করে একজন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর অন্যদিকে আরেকজন সালাতে ইমামতি করতে গিয়ে সূরা কাফিরূণে نَحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ পড়েন। যার অর্থ হয় ঠিক এমন ‘আমরা ইবাদত করি তোমরা যাদের ইবাদত কর’। এতে আয়াতের মর্মটা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল। এ আয়াতে সরাসরি মদপান করাকে নিষেধ করা হয়নি তবে মদ্যপবস্থায় সালাত আদায় করতে নিষেধ করার উদ্দেশ্য পরক্ষোভাবে মদপান থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ পাক।কারণ তৎকালীন আরবদের প্রিয় পানীয় ছিলো মদপান তাই ধীরগতিতে তাদেরকে মদের প্রতি নিরুৎসাহিত করাই ছিলো আল্লাহ পাকের কৌশল।


এর পর মহান রাব্বুল আলামীন আরো ইরশাদ করেন,
يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيْهِمَا إِثْمٌ كَبِيْرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا-
অর্থাৎ ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলে দিন যে, এ দু’টির মধ্যে রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য রয়েছে কিছু উপকারিতা। তবে এ দু’টির পাপ এ দু’টির উপকারিতার চাইতে অধিক (সূরা বাক্বারাহ ২১৯)।
কিছু কিছু সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এসে মদের অপকারিতা সম্পর্কে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত হতে চান। তখন উপরোক্ত আয়াতে কারীমা নাযিল হয়, এ আয়াত নাযিল হওয়ার ফলে বহু লোক মদ-জুয়া ছেড়ে দেন।

পরবর্তীতে এ আয়াত স্পষ্ট করেছেন মদপান এটি শয়তানের কাজ। যেমন: আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِيْ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنْتُم مُّنْتَهُوْنَ-
অর্থাৎ, আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বিরত থাক। তাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে’।‘শয়তান তো কেবল চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পরস্পরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহপাকের স্মরণ ও সালাত হতে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে কি?’ (সূরা মায়েদাহ ৯০-৯১)।
মোটকথা ফিতনা ফাসাদসহ মানবকল্যাণের সর্বদিক বিবেচনা করে বান্দা আল্লাহ পাকের ইবাদাত থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিতে মদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

?এবার আসুন, মদ সম্পর্কে হাদীসে রাসুলে (দরুদপাঠ) কি বলা হয়েছে।
১. হজরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَعَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَجُلًا قَدِمَ مِنَ الْيَمَنِ فَسَأَلَ النَّبِىَّ ﷺ عَنْ شَرَابٍ يَشْرَبُوْنَه بِأَرْضِهِمْ مِنَ الذُّرَةِ يُقَالُ لَهُ الْمِزْرُ فَقَالَ النَّبِىُّ ﷺ : «أوَ مُسْكِرٌ هُوَ؟» قَالَ : نَعَمْ قَالَ : «كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ إِنَّ عَلَى اللّٰهِ عَهْدًا لِمَنْ يَشْرَبُ الْمُسْكِرَ أَنْ يَسْقِيَه مِنْ طِينَةِ الْخَبَالِ». قَالُوا : يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ! وَمَا طِينَةُ الْخَبَالِ؟ قَالَ : «عَرَقُ أَهْلِ النَّارِ أَوْ عُصَارَةُ أَهْلِ النَّارِ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ
একদিন ইয়ামান থেকে জনৈক ব্যক্তি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ‘জোয়ার’ হতে প্রস্তুতকৃত মদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, যা ‘মিয্র’ বলে পরিচিত তাদের দেশে পান করা হয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তা কি নেশা উদ্রেক করে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, নেশা উদ্রেককারী এমন প্রত্যেক জিনিসই হারাম। আর আল্লাহ তা‘আলার ওয়া‘দাহ্ হলো, যে ব্যক্তি কোনো নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস পান করবে, তিনি তাকে ‘ত্বীনাতুল খবাল’ পান করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহর রসূল! ‘ত্বীনাতুল খবাল’ কি জিনিস? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তা জাহান্নামীদের শরীরের ঘাম অথবা বলেছেন, জাহান্নামীদের রক্ত ও পুঁজ।(সহীহ মুসলিম ২০০২/নাসায়ী ৫৭০৯)

২. উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়িশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : سُئِلَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ عَنِ الْبِتْعِ وَهُوَ نَبِيذُ الْعَسَلِ فَقَالَ : «كُلُّ شَرَابٍ أَسْكَرَ فَهُوَ حَرَامٌ». مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিত্‘ই (মধুর প্রস্তুতকৃত মদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যে কোনো নেশা সৃষ্টিকারী পানীয় হারাম।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ/মিশকাত ৩৬৩৭)

৩.হজরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে আরো একটি হাদিস বর্ণিত,
وَعَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ : «مَا أَسْكَرَ كَثِيرُه فَقَلِيلُه حَرَامٌ». رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَأَبُوْ دَاودَ وَابْنُ مَاجَهْ
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে জিনিসে অতিমাত্রায় নেশা আনয়ন করে, তার সামান্য পরিমাণও হারাম। (তিরমিযী ১৮৬৫/আবূ দাঊদ ৩৬৮১)

৪. সাহাবীয়ে রাসুল হজরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ : لَعَنَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ فِى الْخَمْرِ عَشَرَةً : عَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَشَارِبَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَاٰكِلَ ثَمَنِهَا وَالْمُشْتَرِىْ لَهَا وَالْمُشْتَرٰى لَه. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ وَابْن مَاجَهْ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদের সাথে সংশ্লিষ্ট দশ ব্যক্তির ওপর লা‘নাত করেছেন- ১। যে মদ তৈরি করে, ২। যে মদ তৈরির নির্দেশ দেয়, ৩। যে মদ পান করে, ৪। যে মদ বহন করে, ৫। যার জন্য মদ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, ৬। যে মদ পান করায়, ৭। যে মদ বিক্রি করে, ৮। যে মদের আয় উপভোগ করে, ৯। যে মদ ক্রয় করে, ১০। যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।(তিরমিযী ১২৯৫/ইবনু মাজাহ ৩৩৮১)

2 comments:

  1. যে সাহাবী মদ্যপান অবস্থায় ইমামতি করেন উনার নাম কি?

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.