ঈদুল ফিতর ও সদকাতুল ফিতর


জুমার খুতবা
########
জুময়াতুল বিদা, রমজান ১৪৩৮ হি: জুন ২০১৭ সাল

বিষয়: ঈদ ও সদকাতুল ফিতর
***************************
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী

খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম।
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। #

بسم الله الرحمن الرحيم
ঈদ:
ঈদ আরবি শব্দ, যার অর্থ-খুশি, আরেক অর্থে ফিরে আসা। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। আল্লাহ রাববুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও বারবার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন।

ঈদের দিনে যে সব কারণে বিশ্ব মুসলিমের হৃদয় খুশিতে ভরে ওঠে, তা হল -ঈদুল ফিতরে সুদীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার মহান আদেশ পালন করে সৌভাগ্য লাভ করে সওয়াবের আশায় আশান্বিত হয়ে ও সদকাতুল ফিতর প্রদান করে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের অভিপ্রায়ে হৃদয় খুশির আনন্দে ভরে ওঠে।

ইসলামে ঈদের প্রচলন: আল্লাহ রাববুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি নিয়ামাত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন ইহুদিরা দুটি দিন খেলা-ধুলা ও আনন্দ ফুর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এ দিন দুটো কি? তারা বলল: আমরা জাহিলী (মুর্খতার) যুগে এ দ’ুদিন আনন্দ-ফুর্তি করতাম। এ কথা শুনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে এ দু’টি উৎসবের পরিবর্তে অধিক উত্তম ও কল্যাণকর দু’টি আনন্দ উৎসবের দিন দান করেছেন, তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন । (আবু দাউদ, নাসায়ী)

ঈদের ফযীলত:
বছরে পাঁচ রাতে দোয়া বিশেষভাবে কবুল হয়। তার মধ্যে দু’ঈদের দু’রাত। এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী, তাসবীহ পাঠ, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, দুরূদ শরীফ ও যিকির-আযকার করে রাত অতিবাহিত করা অতি উত্তম।


হাদীছ শরীফে রয়েছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকবে, যেদিন অন্য সমস্ত দিল মরবে, সেদিন তার দিল মরবে না।” এর অর্থ হলো- ক্বিয়ামতের দিন অন্যান্য দিল পেরেশানীতে থাকলেও দু’ঈদের রাতে জাগরণকারী ব্যক্তির দিল শান্তিতে থাকবে। (তবারানী শরীফ)

নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে,সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন ভয়ংকর আতংক ভাব থেকে বেঁচে থাকবে।”

অন্য এক হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “ঈদের রাতে উম্মতে মুহাম্মদীকে ক্ষমা করা হয়। কারণ, কর্মচারীদেরকে কাজ থেকে ফারিগ হওয়ার পর ভাতা দেয়া হয়।”

ঈদুল ফিতরের দিন করণীয় কাজসমূহ:

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। নিজ মহল্লার মসজিদে ফজরের নামায আদায় করা। মিসওয়াক করা। উত্তম রূপে গোসল করা। সাধ্যমত উত্তম পোশাক পরিধান করা। খোশবু ব্যবহার করা। নামাযের জন্য ঈদগাহে যাবার আগ সদকায়ে ফিতর আদায় করা। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য বা বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদগাহে একপথে যাওয়া, অন্য পথে পত্যাবর্তন করা। ঈদের নামায ঈদ গাহে আদায় করা। ঈদগাহে যাওয়া এবং আসার সময় নিম্নক্তো তাকবীর আস্তে আস্তে বলা- “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লালাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।” সামর্থনুযায়ী অধিক পরিমান দান-খয়রাত করা। ঈদের দিনে চেহারায় খুশি ভাব প্রকাশ করা এবং কারো সাথে দেখা হলে, হাসিমুখে কথা বলা উচিত।

সদকাতুল ফিতর________________________________________
আমাদের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরেকটি অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের ইবাদত-বন্দেগীতে কোন ত্রুটি হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। যেমন নফল নামায দ্বারা ফরজ নামাযের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এমনি সিয়াম পালনে যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান দিয়েছেন। সাথে সাথে দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষেরা যেন ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থাও দিয়েছেন।

কেউ যেন অর্থাভাবে ঈদের খুশি থেকে বঞ্চিত না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইসলামী সমাজকে এ বিধান দিয়েছেন। এ ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে। তিনিই তো সিয়াম পূর্ণ করা ও রমযানের রাতে কিয়াম সহ অন্যান্য নেক আমল এবং কল্যাণকর কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন ” নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্বরণ করে, অতঃপর সালাত আদায় করে ” [ সূরা আলা ১৪-১৫]

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য ও মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য।

ঈদের সালাতের আগে আদায় করলে তা সদাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গন্য হবে। [আবু দাউদ ও ইবন মাজাহ]

সদকাতুল ফিতরের অর্থ:

সদকাতুল ফিতর অর্থ ফিতরের দিনের সদকা। ফিতর বলতে ঈদুল ফিতর বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, ঈদুল ফিতরের দিন দেয়া সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। একে যাকাতুল ফিতর বা ফেতরাও বলা হয়ে থাকে।

সদকাতুল ফিতরের বিধান:

সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মুসলিমদের উপর আবশ্যক করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন : ‘আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক (সূরা হাসর ৭)

কার ওপর ওয়াজীব :

ইমাম আবু হানীফা বাহমাতুল্লাহ আলাইহির মতে ঐ ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব যে ঈদের দিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ হিসেবে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সম-পরিমাণ সম্পদের মালিক। তবে যাকাতের ন্যায় এক্ষেত্রে এক বৎসর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। সামর্থ্যবান না হলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজীব হবে না।

কার পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজীব:

নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান বা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজীব। সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেখান থেকে আদায় করা যাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজীব নয়। তবে আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। কোনো এতিম শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করতে হবে।

কখন ওয়াজীব হয়:

সদকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজীব হয়। কাজেই সেদিন ভোরের আগে যে জন্ম নিয়েছে, বা এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে, তাকেও এই সদকা আদায় করতে হবে। কেউ যদি সেদিন ভোরের আগে মারা যায়, তার ওপর সদকা ওয়াজীব হবে না। আবার ভোর হবার পর কেউ জন্ম নিলে তার পক্ষ থেকেও সদকা আদায় করা ওয়াজীব হবে না।

কখন আদায় করতে হয়:

ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামায পড়তে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে যাকাতের ন্যায় সেই সময়ের আগেও আদায় করা যেতে পারে। আবার কোনো কারণে সময় মতো আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যাবে। কেউ আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী আদায় করে দিলেও আদায় হয়ে যাবে। ওয়াজিব হচ্ছে, সদকাতুল ফিতর তার প্রাপকের হাতে সরাসরি বা অন্য কোন মাধ্যমে যথা সময়ে সালাতের আগে পৌঁছানো। যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে প্রদানের নিয়ত করে, অথচ তার সঙ্গে বা তার নিকট পৌঁছতে পারে এমন কারো সঙ্গে সাক্ষাত না হয়, তাহলে অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবে, বিলম্ব করবে না।

সদকাতুল ফিতর কাকে দেবেন:

নিজ এলাকার অভাবী ও দরিদ্র যারা যাকাত গ্রহণের অধিকার রাখে এমন অভাবী লোকদেরকে। ঋণ আদায়ে অক্ষমকে প্রয়োজন পরিমাণ ফিতরা দেয়া যাবে।

No comments

Powered by Blogger.