সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ
সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ
জুমার খুতবা
১ জুমা, জুমাদা আল উখরা, ১৪৩৮ হি: March -২০১৭
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ: গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!
“আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকার” ইসলামের একটি অত্যবশ্যকীয় দায়িত্ব। একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। তার মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। তার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির বিস্তার ঘটে। কল্যাণ ও ঈমান বিস্তৃতি লাভ করে। যিনি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।
আজকে আমাদের সমাজে ইসলামের এই স্তম্ভটাই পালনে আমরা সবচেয়ে বেশী অবহেলা করছি, আমাদের সমাজে নির্বিচারে অন্যায়, জুলুম, পাপ কার্য সংঘটিত হচ্ছে কিন্তু আমরা নিরব, আমরা এমন ভাবে আখেরাতকে ছেড়ে দুনিয়া মুখি হয়ে গেছি যে এখন আর আমাদের কোন অনৈতিক কাজেই কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। বরং আমরা কেউ কেউ অন্যায় কাজের সহযোগিতা করছি বিভিন্ন ভাবে। অথচ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করাও এক ধরনের জেহাদ আর এই জেহাদ থেকেই আমরা মুসলমানেরা আজ।
মহান রাব্বুল আলামীন আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন কারীদের প্রশংসা এবং তাদের পরিণাম ও শেষ ফল কল্যাণময় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই সফল কাম। (আলে ইমরান : ১০৪) এই আয়াতে আল্লাহ “সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ” কারীদের সফল কাম বলেছেন অর্থাৎ এই কাজটি যারাই করবে তারাই সফল হবে।
আল্লাহ অন্য এক আয়াতে বলেছেন,”তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবরা যদি ঈমান আনতো, তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। (আলে ইমরান: ১১০) আল্লাহ এই আয়াতেও উম্মতি মুহাম্মদিকে শ্রেষ্ট উম্মত বলে সম্ভধন করেছেন কারন এই উম্মত “সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ” করে থাকে।
হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ করবে আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। যদি না কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। অত:পর তোমরা তাকে ডাকবে আর তোমাদের ডাকের সাড়া দেয়া হবে না। (।[তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪০।]
যুগে যুগে এ পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নবী ও রাসূলকে। যাঁরা স্ব-স্ব জাতিকে সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং অসৎ ও অকল্যাণকর কাজ হতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগুতকে পরিত্যাগ করবে”[নহল-৩৬]।
আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁকে হেদায়াতের মশাল হিসেবে যে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন প্রদান করা হয়েছে তার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে অন্ধকার থেকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, গোমরাহী থেকে হেদায়াতের দিকে, কুফরীর অন্ধকার হতে ঈমানের আলোর দিকে আহ্বান জানানো। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,“আলিফ-লাম-রা, এ হচ্ছে কিতাব, আমরা তোমার প্রতি তা নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে ধাবিত করতে পার, এমন পথে যা প্রবলপরাক্রমশালী, প্রশংসিতের।’’[ইবরাহীম-০১]
পৃথিবীতে মানুষ ধোঁকা প্রবণ, দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহে পড়ে অনন্ত অসীম দয়ালু আল্লাহর কথা স্মরণ থেকে ভুলে যেতে পারে। সেজন্যে প্রত্যেক সৎ কর্মপরায়ণের উচিৎ পরস্পর পরস্পরকে সদুপদেশ দেয়া, সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা। মহান আল্লাহ ধমক দিয়ে বলেন- “হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহান রব সম্পর্কে ধোঁকা দিয়েছে?”[ইনফিতার-৬]
অতএব বলা যায় যে, বিভিন্নভাবে এ পৃথিবীতে মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। আর তা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো পারস্পারিক সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা ও অসৎ এবং গুনাহের কাজ বর্জন করা। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন: “তোমরা পূণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘণের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না।”[আল মায়েদা-০২] আল্লাহ বলেন-“সময়ের কসম, নিশ্চয় আজ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।”[অসর-১-৩]
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ রাসূলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য: প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ গুণের পথিকৃত ছিলেন। তিনি নবুওয়ত প্রকাশের পূর্বে অন্যায় অবিচার রুখতে হিলফুল ফুযুলে অংশ নিয়েছেন। ছোট বেলা থেকে মৌলিক মানবীয় সৎ গুণাবলী তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠায় ‘আল-আমিন’, ‘আল সাদিক’ উপাধিতে তিনি ভুষিত ছিলেন। তাঁর গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন-“তিনি সৎকাজের আদেশ করেন এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করেন। মানবজাতির জন্য সকল উত্তম ও পবিত্র জিনিসগুলো বৈধ করেন এবং খারাপ বিষয়গুলো হারাম করেন।’’[আ’রাফ-১৫৭] এজন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বলেছেন- “আমি সকল পবিত্র চরিত্রাবলী পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’’[ইমাম মালিক, মুয়াত্তা ৫/২৫১।]
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা মুমিনের গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত: সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দান মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। মুমিন নিজে কেবল সৎকাজ করবে না, বরং সকলকে সে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাতে হবে। কেননা, তারা পরস্পরের বন্ধু। অতএব একবন্ধু অপর বন্ধুর জন্য কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করতে পারে না। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন- “মুমিন নারী ও পুরুষ তারা পরস্পরের বন্ধু। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত পরিশোধ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক যাদের প্রতি অচিরেই আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।’’[তাওবাহ-৭১]
কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মুমিনের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সকল স্থানে অন্যান্য গুণাবলীর পাশাপাশি অন্যতম গুণ হিসেবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অবতারণা করা হয়েছে। কুরআনে এসেছে: “তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, আল্লাহর গোলামীর জীবন-যাপনকারী। তাঁর প্রশংসা উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য যমীনে পরিভ্রমণকারী, তাঁর সম্মুখে রুকু ও সিজদায় অবনত। সৎ কাজের আদেশ দানকারী, অন্যায়ের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী। হে নবী, তুমি এসব মুমিনদের সুসংবাদ দাও।”[সূরা আত তাওবা:১১২।]
জাতিকে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করা ফরযে-ই- কিফাইয়াহ: এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ‘ইরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি জাতি হওয়া উচিত যারা সকল ভাল তথা উত্তম বিষয়ের দিকে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করবে, আসলে তারাই হচ্ছে সফলকাম সম্প্রদায়।’’ (সূরা-আলে ইমরান:১০৪) অনুরূপভাবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করা নির্দিষ্ট করে প্রত্যেকের উপর বর্তাবে না; বরং পবিত্র কুরআনের প্রমাণ অনুসারে সেটা ওয়াজিব-ই-কিফাইয়াহ। জিহাদও ঠিক অনুরূপভাবে ওয়াজিব-ই-কিফায়াহ। অতএব সেটার দায়িত্বশীল যখন সেটা সম্পাদনে ব্রতী হবেন না, তখন সকল সামর্থ্য ব্যক্তিগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ দায়িত্ব পালন না করার দোষে সমভাবে দোষী হবেন। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবেই বুঝা গেল যে, প্রতিটি মানুষের উপরই তার শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ দায়িত্ব বর্তাবে। যেমন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে যে কেউ একটি অসৎকাজ (হতে) দেখবে, সে যেন তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। তবে যদি সে ঐরূপ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কথা দ্বারা যেন তাকে প্রতিহত করে, যদি এরপরও করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করে। আর সেটা হবে সবচাইতে দুর্বল ঈমান।’’(বুখারী: কিতাবুল ‘ইলম; মুসলিম: কিতাবুল ঈমান;মুসলিম হা/৫০, মিশকাত হা/১৫৭। আবু দাউদ; বা-বুল আমরি ওয়ান্নাহই; ইবনে মাযাহ: কিতাবুল ফিতান, বাবুল আমরি বিল মা’রূফি ওয়ান্নাহই আনিল মুনকার; আত-তিরমিযী: কিতাবুল রাইয়্যাত, আল-নাসায়ী: কিতাবুল ঈমান; আল-দারিমী: কিতাবুর রূইয়্যা; ইবনে হাম্বাল ২/৪)
শ্রেষ্ঠ জাতির বৈশিষ্ট্য: প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী ‘আনিল মুনকার’ যা উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এর আবশ্যকতা সর্বাবস্থায় সকলের জন্য প্রযোজ্য। দায়িত্বশীলরা যদি দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী দন্ডবিধি বাস্তবায়ন না করে, তাহ’লে সে সমাজের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, “আল্লাহর দন্ড সমূহ বাস্তবায়নে অলসতাকারী এবং অপরাধী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ লোকদের মত, যারা একটি জাহাযে আরোহণের জন্য লটারী করল। তাতে কেউ উপরে ও কেউ নীচতলায় বসল। নীচতলার যাত্রীরা উপরতলায় পানি নিতে আসে। তাতে তারা কষ্ট বোধ করে। তখন নীচতলার একজন কুড়াল দিয়ে পাটাতন কাটতে শুরু করল। উপরতলার লোকেরা এসে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, উপরে পানি আনতে গেলে তোমরা কষ্ট বোধ কর। অথচ পানি আমাদের লাগবেই। এ সময় যদি উপরতলার লোকেরা তার হাত ধরে, তাহলে সে বাঁচল তারাও বাঁচল। আর যদি তাকে এভাবে ছেড়ে দেয়, তাহ’লে তারা তাকে ধ্বংস করল এবং নিজেরাও ধ্বংস হল’।[বুখারী, মিশকাত হা/৫১৩৮।]
যেমন হযরত আবুবকর ছিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যখন লোকেরা কোন অন্যায় কাজ হতে দেখে অথচ তা পরিবর্তন করে না, সত্বর তাদের সকলের উপর আল্লাহ তাঁর শাস্তি ব্যাপকভাবে নামিয়ে দেন’।[ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪২।]
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله رب العالمين.
জুমার খুতবা
১ জুমা, জুমাদা আল উখরা, ১৪৩৮ হি: March -২০১৭
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ: গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد!
“আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকার” ইসলামের একটি অত্যবশ্যকীয় দায়িত্ব। একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। তার মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। তার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির বিস্তার ঘটে। কল্যাণ ও ঈমান বিস্তৃতি লাভ করে। যিনি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।
আজকে আমাদের সমাজে ইসলামের এই স্তম্ভটাই পালনে আমরা সবচেয়ে বেশী অবহেলা করছি, আমাদের সমাজে নির্বিচারে অন্যায়, জুলুম, পাপ কার্য সংঘটিত হচ্ছে কিন্তু আমরা নিরব, আমরা এমন ভাবে আখেরাতকে ছেড়ে দুনিয়া মুখি হয়ে গেছি যে এখন আর আমাদের কোন অনৈতিক কাজেই কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। বরং আমরা কেউ কেউ অন্যায় কাজের সহযোগিতা করছি বিভিন্ন ভাবে। অথচ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করাও এক ধরনের জেহাদ আর এই জেহাদ থেকেই আমরা মুসলমানেরা আজ।
মহান রাব্বুল আলামীন আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন কারীদের প্রশংসা এবং তাদের পরিণাম ও শেষ ফল কল্যাণময় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই সফল কাম। (আলে ইমরান : ১০৪) এই আয়াতে আল্লাহ “সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ” কারীদের সফল কাম বলেছেন অর্থাৎ এই কাজটি যারাই করবে তারাই সফল হবে।
আল্লাহ অন্য এক আয়াতে বলেছেন,”তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবরা যদি ঈমান আনতো, তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। (আলে ইমরান: ১১০) আল্লাহ এই আয়াতেও উম্মতি মুহাম্মদিকে শ্রেষ্ট উম্মত বলে সম্ভধন করেছেন কারন এই উম্মত “সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ” করে থাকে।
হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ করবে আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। যদি না কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। অত:পর তোমরা তাকে ডাকবে আর তোমাদের ডাকের সাড়া দেয়া হবে না। (।[তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪০।]
যুগে যুগে এ পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নবী ও রাসূলকে। যাঁরা স্ব-স্ব জাতিকে সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং অসৎ ও অকল্যাণকর কাজ হতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগুতকে পরিত্যাগ করবে”[নহল-৩৬]।
আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁকে হেদায়াতের মশাল হিসেবে যে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন প্রদান করা হয়েছে তার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে অন্ধকার থেকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, গোমরাহী থেকে হেদায়াতের দিকে, কুফরীর অন্ধকার হতে ঈমানের আলোর দিকে আহ্বান জানানো। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,“আলিফ-লাম-রা, এ হচ্ছে কিতাব, আমরা তোমার প্রতি তা নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে ধাবিত করতে পার, এমন পথে যা প্রবলপরাক্রমশালী, প্রশংসিতের।’’[ইবরাহীম-০১]
পৃথিবীতে মানুষ ধোঁকা প্রবণ, দুনিয়ার চাকচিক্য ও মোহে পড়ে অনন্ত অসীম দয়ালু আল্লাহর কথা স্মরণ থেকে ভুলে যেতে পারে। সেজন্যে প্রত্যেক সৎ কর্মপরায়ণের উচিৎ পরস্পর পরস্পরকে সদুপদেশ দেয়া, সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা। মহান আল্লাহ ধমক দিয়ে বলেন- “হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহান রব সম্পর্কে ধোঁকা দিয়েছে?”[ইনফিতার-৬]
অতএব বলা যায় যে, বিভিন্নভাবে এ পৃথিবীতে মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। আর তা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো পারস্পারিক সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা ও অসৎ এবং গুনাহের কাজ বর্জন করা। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন: “তোমরা পূণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘণের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না।”[আল মায়েদা-০২] আল্লাহ বলেন-“সময়ের কসম, নিশ্চয় আজ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।”[অসর-১-৩]
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ রাসূলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য: প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ গুণের পথিকৃত ছিলেন। তিনি নবুওয়ত প্রকাশের পূর্বে অন্যায় অবিচার রুখতে হিলফুল ফুযুলে অংশ নিয়েছেন। ছোট বেলা থেকে মৌলিক মানবীয় সৎ গুণাবলী তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠায় ‘আল-আমিন’, ‘আল সাদিক’ উপাধিতে তিনি ভুষিত ছিলেন। তাঁর গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন-“তিনি সৎকাজের আদেশ করেন এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করেন। মানবজাতির জন্য সকল উত্তম ও পবিত্র জিনিসগুলো বৈধ করেন এবং খারাপ বিষয়গুলো হারাম করেন।’’[আ’রাফ-১৫৭] এজন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বলেছেন- “আমি সকল পবিত্র চরিত্রাবলী পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’’[ইমাম মালিক, মুয়াত্তা ৫/২৫১।]
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা মুমিনের গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত: সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দান মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। মুমিন নিজে কেবল সৎকাজ করবে না, বরং সকলকে সে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাতে হবে। কেননা, তারা পরস্পরের বন্ধু। অতএব একবন্ধু অপর বন্ধুর জন্য কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করতে পারে না। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন- “মুমিন নারী ও পুরুষ তারা পরস্পরের বন্ধু। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত পরিশোধ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক যাদের প্রতি অচিরেই আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।’’[তাওবাহ-৭১]
কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মুমিনের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সকল স্থানে অন্যান্য গুণাবলীর পাশাপাশি অন্যতম গুণ হিসেবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অবতারণা করা হয়েছে। কুরআনে এসেছে: “তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, আল্লাহর গোলামীর জীবন-যাপনকারী। তাঁর প্রশংসা উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য যমীনে পরিভ্রমণকারী, তাঁর সম্মুখে রুকু ও সিজদায় অবনত। সৎ কাজের আদেশ দানকারী, অন্যায়ের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী। হে নবী, তুমি এসব মুমিনদের সুসংবাদ দাও।”[সূরা আত তাওবা:১১২।]
জাতিকে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করা ফরযে-ই- কিফাইয়াহ: এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ‘ইরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি জাতি হওয়া উচিত যারা সকল ভাল তথা উত্তম বিষয়ের দিকে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করবে, আসলে তারাই হচ্ছে সফলকাম সম্প্রদায়।’’ (সূরা-আলে ইমরান:১০৪) অনুরূপভাবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করা নির্দিষ্ট করে প্রত্যেকের উপর বর্তাবে না; বরং পবিত্র কুরআনের প্রমাণ অনুসারে সেটা ওয়াজিব-ই-কিফাইয়াহ। জিহাদও ঠিক অনুরূপভাবে ওয়াজিব-ই-কিফায়াহ। অতএব সেটার দায়িত্বশীল যখন সেটা সম্পাদনে ব্রতী হবেন না, তখন সকল সামর্থ্য ব্যক্তিগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ দায়িত্ব পালন না করার দোষে সমভাবে দোষী হবেন। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবেই বুঝা গেল যে, প্রতিটি মানুষের উপরই তার শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ দায়িত্ব বর্তাবে। যেমন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে যে কেউ একটি অসৎকাজ (হতে) দেখবে, সে যেন তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। তবে যদি সে ঐরূপ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কথা দ্বারা যেন তাকে প্রতিহত করে, যদি এরপরও করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করে। আর সেটা হবে সবচাইতে দুর্বল ঈমান।’’(বুখারী: কিতাবুল ‘ইলম; মুসলিম: কিতাবুল ঈমান;মুসলিম হা/৫০, মিশকাত হা/১৫৭। আবু দাউদ; বা-বুল আমরি ওয়ান্নাহই; ইবনে মাযাহ: কিতাবুল ফিতান, বাবুল আমরি বিল মা’রূফি ওয়ান্নাহই আনিল মুনকার; আত-তিরমিযী: কিতাবুল রাইয়্যাত, আল-নাসায়ী: কিতাবুল ঈমান; আল-দারিমী: কিতাবুর রূইয়্যা; ইবনে হাম্বাল ২/৪)
শ্রেষ্ঠ জাতির বৈশিষ্ট্য: প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী ‘আনিল মুনকার’ যা উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এর আবশ্যকতা সর্বাবস্থায় সকলের জন্য প্রযোজ্য। দায়িত্বশীলরা যদি দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী দন্ডবিধি বাস্তবায়ন না করে, তাহ’লে সে সমাজের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, “আল্লাহর দন্ড সমূহ বাস্তবায়নে অলসতাকারী এবং অপরাধী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ঐ লোকদের মত, যারা একটি জাহাযে আরোহণের জন্য লটারী করল। তাতে কেউ উপরে ও কেউ নীচতলায় বসল। নীচতলার যাত্রীরা উপরতলায় পানি নিতে আসে। তাতে তারা কষ্ট বোধ করে। তখন নীচতলার একজন কুড়াল দিয়ে পাটাতন কাটতে শুরু করল। উপরতলার লোকেরা এসে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, উপরে পানি আনতে গেলে তোমরা কষ্ট বোধ কর। অথচ পানি আমাদের লাগবেই। এ সময় যদি উপরতলার লোকেরা তার হাত ধরে, তাহলে সে বাঁচল তারাও বাঁচল। আর যদি তাকে এভাবে ছেড়ে দেয়, তাহ’লে তারা তাকে ধ্বংস করল এবং নিজেরাও ধ্বংস হল’।[বুখারী, মিশকাত হা/৫১৩৮।]
যেমন হযরত আবুবকর ছিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যখন লোকেরা কোন অন্যায় কাজ হতে দেখে অথচ তা পরিবর্তন করে না, সত্বর তাদের সকলের উপর আল্লাহ তাঁর শাস্তি ব্যাপকভাবে নামিয়ে দেন’।[ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪২।]
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين. والحمد لله رب العالمين.
nicr
ReplyDelete