ইসলাম প্রচারে গউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানীর অবদান
জুমার খুতবাঃ
২য় জুমা, রবিউল আখের ১৪৪০ হিজরী, 21 December 2018.
বিষয়: ইসলাম প্রচারে হযরত গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবদানঃ
*******************************************************************
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির হেদায়তের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এ ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটলেও হেদায়তের দ্বার সদা উম্মোচিত ছিল, কখনও বন্ধ হয়নি। আওলাদে রাসূল, আউলিয়ায়ে কেরাম ও সত্যিকার নায়েবে রাসূল ওলামাগণ কাল-কালান্তরে হেদায়তের প্রজ্জ্বলিত এ মশালকে সদা অনির্বাণ রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং আছেন। পাশাপাশি মহান আল্লাহ্ এ দ্বীনের সংস্কারের জন্য প্রতি শতাব্দীতে একজন করে মুজাদ্দিদ বা দ্বীনের সংস্কারকও প্রেরণ করে থাকেন, রাসূল-এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন একজন মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি এ দ্বীনের সংস্কার করবেন। [তিরমিযী]
গাউসুল আযম আবু মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল দ্বীনের সংস্কারক ছিলেন না বরং ইসলাম বা দ্বীনে ইসলামের একজন পুনরুজ্জীবনকারীও ছিলেন। তাই তিনি ‘মুহিউদ্দিন’ বা দ্বীনের পুনরুজ্জীবনকারী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
কারণ তিনি এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন যখন ভিন্নধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তার জগতকে দারুণভাবে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করে ফেলছিল। শিরক, কুফর ও বিদআত নিত্য নবরূপে সঞ্চারিত হচ্ছিল মুসলিম মননে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। তাওহীদ ও রিসালতের পথ থেকে কেউ কেউ ছিটকে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল।
অন্যদিকে খ্রিস্টান জগত তদানীন্তন মুসলিম দুনিয়াকে ধ্বংস করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সেই সময় উম্মতে মুহাম্মদীকে সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য তাঁর মত একজন মুজাদ্দিদের, একজন পথ প্রদর্শকের, একজন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। একজন মহান গাউস, একজন গাউসুল আজম, একজন দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী তথা মুহিউদ্দীন হয়ে তিনি আবির্ভূত হলেন। এমনি সময়ে হযরত বড়পীর সঠিক ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন তাই তিনি ‘মুহিউদ্দীন’ উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত গাউসে পাক এ উপাধি সম্পর্কে বলেন, ৫১১ হিজরিতে জুমার দিন আমি যখন সফর থেকে বাগদাদে প্রবেশ করছিলাম তখন খুবই দুর্বল, অসুস্থ ও বিকৃত চেহারার এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে গমন করছিলাম এমন সময় সে আমাকে ‘‘আস্সালামু আলইকা, হে আবদুল কাদের’ বলে সালাম দিল, আমিও তার সালামের উত্তর দিলাম। তখন সে বলল, আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য কর। আমি যখন তাকে বসানোর জন্য তার গায়ে হাত দিলাম, দেখলাম হঠাৎ সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ, সবল ও সমুজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেল, এতে আমি বিচলিত হয়ে গেলাম। তখন সে আমাকে বলল, ভয়ের কোন কারণ নেই, মূলত আমি আপনার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রেখে যাওয়া যাওয়া দ্বীন-ইসলাম, যা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষা করছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার মাধ্যমে আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন, তাই আজ থেকে আপনি ‘মুহিউদ্দিন’। পরক্ষণে আমি যখন বাগদাদের জামে মসজিদের নিকটবর্তী হলাম তখন এক ব্যক্তি আমাকে ‘হে হযরত মুহিউদ্দিন’ বলে সম্বোধন করল। জুমার নামাজ শেষে ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ বলতে বলতে দলে দলে লোক এসে আমার হাত চুম্বন করতে লাগলো। অথচ এর পূর্বে কেউ কখনও আমাকে এ উপাধিতে সম্বোধন করেনি। [বাহজাতুল আসরার, কালায়েদুল জাওয়াহের ও মাজহারী জামালে মুস্তফায়ী]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘প্রত্যেকে তাই করবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’
[বুখারী] ‘‘যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সে কাজকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। [বুখারী]
বিভিন্ন মানুষকে নানা ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর হযরত গাউসে পাককে সৃষ্টি করা হয়েছে এ দ্বীনের মহান খেদমত আনজাম দেয়ার জন্যে, যা তাঁর শৈশবকাল থেকেই বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। তিনি নিজেই বলছেন, আমি ছোট বেলায় হাল-চাষ করার জন্য যখন গরুর পিঠে হাত রাখলাম তখন গরুটি পিছন ফিরে আমাকে বলল, ‘‘হে আবদুল কাদের তোমাকে তো চাষাবাদ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, ‘‘যখন আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতে চাইতাম তখন অদৃশ্য থেকে কেউ আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘হে বরকতময়, আমার দিকে এসো’’। [ক্বালায়েদুল জাওয়াহের]
এভাবে মাতৃগর্ভে ১৮ পারা কোরআন হিফজ, জন্মের পরক্ষণ থেকেই রোজা পালন করা ইত্যাদি প্রমাণ করে আল্লাহ্ পাক তাঁকে সৃষ্টির পেছনে এক মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। যা তাঁর পরবর্তী জীবনে হুবহু প্রতিফলিত হয়।
জন্ম:
===
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্মগ্রহণ করেন ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৪৭০ হিজরীর রমযান মাসের ১ তারিখ সেহরির ওয়াক্তে পারস্যের কাম্পিায়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে জিলান বা গীলান অঞ্চলের নায়ক মহল্লায় হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধারায় এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে। তাঁর আম্মা সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহমাতুল্লাহি আলায়হিও ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধারার এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের কন্যা।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির আব্বা সৈয়দ আবু সালিহ মূসা জঙ্গীদুস্ত ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত সূফী এবং আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা।
শিক্ষাঃ
====
শৈশবেই আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পিতৃহারা হন। অতি শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ হিফজ করেন। বিভিন্ন বর্ণনা মতে তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালেই ১৮ পারা কুরআন শরীফ হিফজ থাকার কারণে কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। এটা প্রকাশ পায় তখন যখন ৪ বছর বয়সে তাঁকে আম্মাজান একজন ক্বারীর কাছে কুরআন মজীদ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। কিন্তু শিক্ষক ও আশপাশের লোকজন যখন দেখলেন যে, অতটুকু শিশু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলার সাথে সাথে একনাগাড়ে সূরা ফাতিহা থেকে ১৮ পারা পর্যন্ত মুখস্থ তিলাওয়াত করছে তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহু মানুষ তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় করলেন এবং সবাই বলাবলি করতে লাগলেন, এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, নিশ্চয়ই এ শিশু একজন মশহুর আল্লাহর ওলী হবেন।
তিনি মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করে জিলান নগরীর এক মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন। তাঁর আম্মা ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাগদাদ তখন মুসলিম খিলাফতের রাজধানী। বাগদাদের ‘নিযামিয়া মাদরাসা’ ছিল তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাগদাদ এসে তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ আলিম ফকীহ্ ও মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে জাহিরের তাবত বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করলেন। তিনি ইলমে তাসাওউফে সর্বোচ্চ কামালাত হাসিল করলেন। তিনি প্রথমে ইলমে তাসাওফের তা’লীম গ্রহণ করেন বিখ্যাত সূফী হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ হাম্মাদ আদ্দাব্বাস রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে। হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ আদ্দাব্বাস তাঁর রুহানী শক্তির ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করে মন্তব্য করেন যে, তিনি এক সময় সর্বশ্রেষ্ঠ সূফী হবেন।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পরবর্তীকালে তাসাওউফের সামগ্রিক জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করার স্বীকৃতিস্বরূপ সূফী হযরত শায়খ আবূ সাঈদ মুখররিমী রহমাতুল্লাহি আলায়হির কাছ থেকে সনদপত্র বা খিলাফতনামা প্রাপ্ত হন। ইতোমধ্যেই শ্রেষ্ঠ আলিম হিসেবে, শ্রেষ্ঠ সূফী হিসেবে, শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে তাঁর নাম বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম দুনিয়ায়। বহু লোক তাঁর দরবারে এসে ভিড় জমাতে থাকে। লোকজনের ভিড় দিনকে দিন বাড়তেই লাগল।
একদিন স্বপ্নে সরকারে দো’আলম নূরে মুজাস্সম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ওয়ায করে মানুষকে সৎপথের দিশা দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর থেকে তিনি সপ্তাহে তিনদিন ওয়ায-মাহফিলের আয়োজন করতেন।
তাঁর ওয়ায শোনার জন্য সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে এসে সমবেত হতো। তিনি অতি দক্ষ বাগ্মী ছিলেন। লোকজন তাঁর মধুর বাণী এবং সুমিষ্ট ওয়ায ঘন্টর পর ঘন্টা মোহিত হয়ে শুনত। তাঁর ওয়াযে এমন এক মোহনীয় শক্তি ছিল যা শুনে সবাই লাভবান হতো।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য, কামালাতের উচ্চ মাকামে উন্নীত হবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, এমন কি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মুরাকাবা-মুশাহাদারত হন। তিনি এই সময় খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন, এমনকি গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেন। জানা যায়, অনেক বছর তিনি বাগদাদ শরীফের বাইরে একটা টিলার উপর একটা জীর্ণ কুটিরে অবস্থান করে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।
ইন্তিকালঃ
=====
৫৬১ হিজরি মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস্ সানি সোমবার রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তিকাল করেন। যে কারণে এ ১১ বলতে ১১ রবিউস্ সানিকেই বুঝানো হয় এবং এ ১১ এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে যায় যে, অনেক খানকা শরীফে এগারো শরীফ বা গিয়ারী শরীফও অনুষ্ঠিত হয়। তিনি শুয়ে আছেন বাগদাদ নগরীতে। বাগদাদ সূফী জগতের বিলায়তের রাজধানী। বাগদাদ গাউসুল আজমের কারণে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
গাউসুল আযম এবং কাদিরীয়া তরিকার ওপর বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় গাউসুল আযমের কয়েকখানি গ্রন্থের তরজমা বের হয়েছে। গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির গ্রন্থরাজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ফতহুল গায়েব, ফতহুর রাব্বানী, সিররুল আসরার, গুনিয়াতুত্ তালেবীন, কাসিদায়ে গাউসিয়া প্রভৃতি।
ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদানঃ
=================
বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সুফিয়ায়ে কেরামের ভূমিকা সর্বজনবিধিত। তাঁরা তাঁদের উন্নত চরিত্র, উদার ভাবধারায় এত সহজে মানুষের অন্তরকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা শক্তি ও তলোয়ারের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি ও হবেও না।
মানবজাতির হেদায়তের ক্ষেত্রে তাদের দু’টি দিক সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। একদিকে আদর্শ, উন্নত চরিত্র, উদারতা, সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা, বিন¤্র মনোভাব, উত্তম মুয়ামালা ইত্যাদিতে তাঁরা ছিলেন অদ্বিতীয়, ফলে তাঁরা খুব সহজে খুব দূরের মানুষকে কাছে আনতে এবং শত্রুকেও বশ করতে সক্ষম ছিলেন। যেমনটি দেখা যায় হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনে।
অন্যদিকে তাঁদের ওয়াজ-নসিহতের মাহফিল ও বৈঠক, যাতে মুসলিম ও অমুসলিম সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল উম্মুক্ত। ফলে তাঁদের আলোচনা দ্বারা মানুষের জীবনে এক আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি।
প্রাথমিকভাবে মজলিস আরম্ভ হয়েছিল দুই তিন জনকে নিয়ে, কিন্তু তাঁর মধুরবাণী ও সুমিষ্ট ওয়াজ-নসিহতে মানুষ বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক আসতে শুরু হলো। এমনকি তাঁর এক একটি মজলিসে সত্তর হাজারেরও অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করতো। তাঁর মাদরাসায় বসার জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা বিধায় বাগদাদের মহাসড়কে তাঁকে ওয়াজ-নসিহত করতে হতো। এভাবে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর মানুষকে হেদায়ত করেন। ‘ফলে তাঁর এমন কোনও মজলিস ছিলনা যেখানে অসংখ্য বিধর্মী ইসলাম গ্রহণ করতো না। পাশাপাশি অসংখ্য ডাকাত, খুনি, পাপাচারী ও অপরাধীতো আছেই যাঁরা তাঁর হাতে তাওবা করে, সঠিক পথে ফিরে আসতো। [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৯]
আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত এ অনুগ্রহের কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন ‘‘আমার হাতে পাঁচ হাজারেরও অধিক ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করেছেন।’’ [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৮]
গবেষক জামালুদ্দিন ফালেহ্ জিলানী তাঁর ‘ইমাম আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি নামক কিতাবে লিখেছেন সবচেয়ে প্রাচীনতম তরিকা হলো কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার প্রবর্তকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তিনি এমন একটি প্রজন্ম গঠনে মহান ভূমিকা রেখেছেন যারা বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফকে খ্রিস্টান দখলদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ কাদেরিয়া তরিকার অনুসারীদের অন্যতম ছিলেন বিম্ববিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, আবদুল কাদের জাজায়েরী, ওমর মুখতার, জেনারেল আবদুর রহমান, রফিক আলী আল জিলানীসহ এ উম্মতের গৌরব করার মত আরও অনেকেই।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শুধুমাত্র উন্নত আদর্শ, উদারতা, মানবপ্রেম, ওয়াজ নসিহত ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেননি বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাঁর খলীফা, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে এমন একটি জামাত গঠন করেন যারা দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। যাঁদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের একটি দল হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি জীবদ্দশায় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন।
হযরত আবদুল কাদের জীলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সরাসরি খলিফা হলেন হযরত বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, যিনি বড়পীর সাহেবের জীবদ্দশায় এবং তাঁরই নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং বাংলাদেশেই শাহাদত বরণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম খানকায়ে কাদেরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।
অনুরূপভাবে হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি যিনি গাউসে পাকের পৌত্র (নাতী) ছিলেন, রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার করেন।
অধ্যাডক ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান তাঁর রচিত ‘ইনতেশারুল ইসলাম ফিল ক্বাররাহ্ আল আফরিকীয়্যাহ্’ গ্রন্থে বলেন, ‘আফ্রিকা মহাদেশে ইসলাম প্রচারে যে তরিকার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হলো তরীকায়ে কাদেরিয়া। অনুরূপভাবে ড. আবদুর রহমান জাকী তাঁর রচিত ‘আল মুসলেমুনা ফি আল আলাম আল ইয়াউম’ নামক কিতাবে একই মন্তব্য করেন।
মাসিক আল ইসলাম ওয়াত তাসাউফ (জানুয়ারি ১৯৬১) তার রিপোর্ট উল্লেখ করেছে সোমালিয়াতে সর্বপ্রথম যে তরিকাটি প্রবেশ করে সেটি হলো কাদেরিয়া তরিকা। ফরাসী প্রাচ্য গবেষক ফানসান মুনতাই ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি মরক্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধে বলেন, ‘চীনের ইনান নামক প্রদেশে একটি মাজার দেখা যায় যার ফলকে লিখা আছে। আবদুর রাজ্জাক বাগদাদির নাম, যিনি দ্বাদশ খ্রিস্টীয় শতাব্দীতে চীনে ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির পৌত্র (নাতী) এবং চীনে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী।’’
হেলী কারবার দানকোচ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোকাজের মুসলমানগণ এখনও হানাফী মাযহাব এবং কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী-কমিউনিউজিয়ামের শাসন ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁদেরকে তাঁদের ঘরে কাদেরিয়া তরিকার ওয়াজিফা পাঠ করতে শুনেছি।
বিশ্বজুড়ে কাদিরয়া তরিকা:
================
শরীয়ত তরীকত হাক্বীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে যে ইলম সম্বলিত ও বিকশিত হয়েছে তাকে বলা হয় ‘ইলমে তাসাওউফ’ বা তাসাওউফ বিজ্ঞান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই এলমে তাসাওউফ চর্চা সূচিত হয়েছে।
কুরআন মজীদে যে তাযকীইয়ায়ে নফস এবং হাদীস শরীফে যে ইহসানের কথা বলা হয়েছে সেটাই মূলতঃ তাসাওউফের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাসাওউফ চর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতি কালক্রমে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিন্যাসিত হয়েছে যেগুলো ত্বরীকা নামে পরিচিত। কাদেরিয়া তরিকা তরিকাসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত।
তিনি ইলমে তাসাওউফ তথা শরীয়ত, তরীক্বত ও হাক্বীক্বত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইসলামের এ অনন্য বিজ্ঞানকে আরও সহজে চর্চার সুবিধার্থে এক আলোচিত ধারার পদ্ধতি বিন্যাস করেন। এটা কাদেরিয়া তরীকা নামে পরিচিতি লাভ করে।
তিনি ইলমে তাসাওফের আলখেল্লা পরা তাঁর কালের সমস্ত বাতিল ফিকাগুলোকে চিহ্ণিত করে তাদের সান্নিধ্যে না যাবার জন্য আহ্বান জানান। তিনি কি কি কারণে ঐ সমস্ত ফিরকাগুলো বাতিল তাও উল্লেখ করে পুস্তক লিখে তা জনগণের মধ্যে প্রচার করেন।
ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরীকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরীক্বা হিসেবে বিবেচিত হয় গাউসুল আযম কর্তৃক বিন্যাসকৃত কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরীকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে গাউসুল আযমের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে। কাদেরিয়া তরিকা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু খানকা গড়ে উঠেছে।
কাদেরিয়া তরিকা প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। এটাই শ্রেষ্ঠ তরিকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরিকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী অসংখ্য খানকা শরীফ রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে। বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার সূচনা হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে কাদেরিয়া তরিকা:
==========================
বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। যতদূর জানা যায় হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি রাজশাহীর শাহ্ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলায়হি, পশ্চিম বাংলার হযরত মনসূর বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলে এ তরীকার ব্যাপক প্রসার ঘটান।
বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি:
=========================
যে ক’জন প্রখ্যাত সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ওলি। ভারতে মধ্যযুগে যে ক’জন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারে উদ্দেশ্যে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান।
খোরাসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদরাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাহচর্যে আসেন এবং তাসাওফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।
তিনি প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরে বাবা আদম শহীদ হন। শহীদ হওয়ার পর তাকে রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি:
===============================
রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যাদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাদের অন্যতম। ওলীকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রিয়তম পৌত্র হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ ছিলেন সে মহান সাধক যিনি রাজশাহীর মত অনগ্রসর স্থানে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছিলেন। তৎকালীন মহাকালগড়ে (বর্তমানে রাজশাহী) দেও রাজাদের অন্যায়-অনাচার, অবিচার ও নানা কুসংস্কার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। বিশেষ করে মানুষ বলি দেয়ার মত নিষ্ঠুর কাজে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলের মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে শান্তির নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাঁর নাম শাহ্ মাখদুম জালাল উদ্দীন রূপোশ। অন্যত্র তাঁর নাম আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ‘তাঁর নাম সায়্যিদ আবদুল কুদ্দুস। শাহ্ মাখদুম রূপোশ নামে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। ‘শাহ্’ মাখদুম, ‘রূপোশ’ এগুলো তাঁর লকব বা উপাধি।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ৬১৫ হিজরির ২ রজব মোতাবেক ১২০৮ খৃস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে পিতৃগ্রহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি। হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির ২৭ পুত্রের একজন। হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হির দ্বিতীয় পুত্র।
২য় জুমা, রবিউল আখের ১৪৪০ হিজরী, 21 December 2018.
বিষয়: ইসলাম প্রচারে হযরত গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবদানঃ
*******************************************************************
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির হেদায়তের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এ ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটলেও হেদায়তের দ্বার সদা উম্মোচিত ছিল, কখনও বন্ধ হয়নি। আওলাদে রাসূল, আউলিয়ায়ে কেরাম ও সত্যিকার নায়েবে রাসূল ওলামাগণ কাল-কালান্তরে হেদায়তের প্রজ্জ্বলিত এ মশালকে সদা অনির্বাণ রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং আছেন। পাশাপাশি মহান আল্লাহ্ এ দ্বীনের সংস্কারের জন্য প্রতি শতাব্দীতে একজন করে মুজাদ্দিদ বা দ্বীনের সংস্কারকও প্রেরণ করে থাকেন, রাসূল-এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন একজন মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি এ দ্বীনের সংস্কার করবেন। [তিরমিযী]
গাউসুল আযম আবু মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল দ্বীনের সংস্কারক ছিলেন না বরং ইসলাম বা দ্বীনে ইসলামের একজন পুনরুজ্জীবনকারীও ছিলেন। তাই তিনি ‘মুহিউদ্দিন’ বা দ্বীনের পুনরুজ্জীবনকারী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
কারণ তিনি এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন যখন ভিন্নধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তার জগতকে দারুণভাবে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করে ফেলছিল। শিরক, কুফর ও বিদআত নিত্য নবরূপে সঞ্চারিত হচ্ছিল মুসলিম মননে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। তাওহীদ ও রিসালতের পথ থেকে কেউ কেউ ছিটকে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল।
অন্যদিকে খ্রিস্টান জগত তদানীন্তন মুসলিম দুনিয়াকে ধ্বংস করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সেই সময় উম্মতে মুহাম্মদীকে সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য তাঁর মত একজন মুজাদ্দিদের, একজন পথ প্রদর্শকের, একজন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। একজন মহান গাউস, একজন গাউসুল আজম, একজন দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী তথা মুহিউদ্দীন হয়ে তিনি আবির্ভূত হলেন। এমনি সময়ে হযরত বড়পীর সঠিক ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন তাই তিনি ‘মুহিউদ্দীন’ উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত গাউসে পাক এ উপাধি সম্পর্কে বলেন, ৫১১ হিজরিতে জুমার দিন আমি যখন সফর থেকে বাগদাদে প্রবেশ করছিলাম তখন খুবই দুর্বল, অসুস্থ ও বিকৃত চেহারার এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে গমন করছিলাম এমন সময় সে আমাকে ‘‘আস্সালামু আলইকা, হে আবদুল কাদের’ বলে সালাম দিল, আমিও তার সালামের উত্তর দিলাম। তখন সে বলল, আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য কর। আমি যখন তাকে বসানোর জন্য তার গায়ে হাত দিলাম, দেখলাম হঠাৎ সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ, সবল ও সমুজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেল, এতে আমি বিচলিত হয়ে গেলাম। তখন সে আমাকে বলল, ভয়ের কোন কারণ নেই, মূলত আমি আপনার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রেখে যাওয়া যাওয়া দ্বীন-ইসলাম, যা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষা করছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার মাধ্যমে আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন, তাই আজ থেকে আপনি ‘মুহিউদ্দিন’। পরক্ষণে আমি যখন বাগদাদের জামে মসজিদের নিকটবর্তী হলাম তখন এক ব্যক্তি আমাকে ‘হে হযরত মুহিউদ্দিন’ বলে সম্বোধন করল। জুমার নামাজ শেষে ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ বলতে বলতে দলে দলে লোক এসে আমার হাত চুম্বন করতে লাগলো। অথচ এর পূর্বে কেউ কখনও আমাকে এ উপাধিতে সম্বোধন করেনি। [বাহজাতুল আসরার, কালায়েদুল জাওয়াহের ও মাজহারী জামালে মুস্তফায়ী]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘প্রত্যেকে তাই করবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’
[বুখারী] ‘‘যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সে কাজকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। [বুখারী]
বিভিন্ন মানুষকে নানা ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর হযরত গাউসে পাককে সৃষ্টি করা হয়েছে এ দ্বীনের মহান খেদমত আনজাম দেয়ার জন্যে, যা তাঁর শৈশবকাল থেকেই বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। তিনি নিজেই বলছেন, আমি ছোট বেলায় হাল-চাষ করার জন্য যখন গরুর পিঠে হাত রাখলাম তখন গরুটি পিছন ফিরে আমাকে বলল, ‘‘হে আবদুল কাদের তোমাকে তো চাষাবাদ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, ‘‘যখন আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতে চাইতাম তখন অদৃশ্য থেকে কেউ আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘হে বরকতময়, আমার দিকে এসো’’। [ক্বালায়েদুল জাওয়াহের]
এভাবে মাতৃগর্ভে ১৮ পারা কোরআন হিফজ, জন্মের পরক্ষণ থেকেই রোজা পালন করা ইত্যাদি প্রমাণ করে আল্লাহ্ পাক তাঁকে সৃষ্টির পেছনে এক মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। যা তাঁর পরবর্তী জীবনে হুবহু প্রতিফলিত হয়।
জন্ম:
===
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্মগ্রহণ করেন ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৪৭০ হিজরীর রমযান মাসের ১ তারিখ সেহরির ওয়াক্তে পারস্যের কাম্পিায়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে জিলান বা গীলান অঞ্চলের নায়ক মহল্লায় হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধারায় এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে। তাঁর আম্মা সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহমাতুল্লাহি আলায়হিও ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধারার এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের কন্যা।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির আব্বা সৈয়দ আবু সালিহ মূসা জঙ্গীদুস্ত ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত সূফী এবং আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা।
শিক্ষাঃ
====
শৈশবেই আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পিতৃহারা হন। অতি শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ হিফজ করেন। বিভিন্ন বর্ণনা মতে তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালেই ১৮ পারা কুরআন শরীফ হিফজ থাকার কারণে কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। এটা প্রকাশ পায় তখন যখন ৪ বছর বয়সে তাঁকে আম্মাজান একজন ক্বারীর কাছে কুরআন মজীদ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। কিন্তু শিক্ষক ও আশপাশের লোকজন যখন দেখলেন যে, অতটুকু শিশু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলার সাথে সাথে একনাগাড়ে সূরা ফাতিহা থেকে ১৮ পারা পর্যন্ত মুখস্থ তিলাওয়াত করছে তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহু মানুষ তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় করলেন এবং সবাই বলাবলি করতে লাগলেন, এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, নিশ্চয়ই এ শিশু একজন মশহুর আল্লাহর ওলী হবেন।
তিনি মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করে জিলান নগরীর এক মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন। তাঁর আম্মা ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাগদাদ তখন মুসলিম খিলাফতের রাজধানী। বাগদাদের ‘নিযামিয়া মাদরাসা’ ছিল তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাগদাদ এসে তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ আলিম ফকীহ্ ও মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে জাহিরের তাবত বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করলেন। তিনি ইলমে তাসাওউফে সর্বোচ্চ কামালাত হাসিল করলেন। তিনি প্রথমে ইলমে তাসাওফের তা’লীম গ্রহণ করেন বিখ্যাত সূফী হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ হাম্মাদ আদ্দাব্বাস রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে। হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ আদ্দাব্বাস তাঁর রুহানী শক্তির ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করে মন্তব্য করেন যে, তিনি এক সময় সর্বশ্রেষ্ঠ সূফী হবেন।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পরবর্তীকালে তাসাওউফের সামগ্রিক জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করার স্বীকৃতিস্বরূপ সূফী হযরত শায়খ আবূ সাঈদ মুখররিমী রহমাতুল্লাহি আলায়হির কাছ থেকে সনদপত্র বা খিলাফতনামা প্রাপ্ত হন। ইতোমধ্যেই শ্রেষ্ঠ আলিম হিসেবে, শ্রেষ্ঠ সূফী হিসেবে, শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে তাঁর নাম বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম দুনিয়ায়। বহু লোক তাঁর দরবারে এসে ভিড় জমাতে থাকে। লোকজনের ভিড় দিনকে দিন বাড়তেই লাগল।
একদিন স্বপ্নে সরকারে দো’আলম নূরে মুজাস্সম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ওয়ায করে মানুষকে সৎপথের দিশা দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর থেকে তিনি সপ্তাহে তিনদিন ওয়ায-মাহফিলের আয়োজন করতেন।
তাঁর ওয়ায শোনার জন্য সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে এসে সমবেত হতো। তিনি অতি দক্ষ বাগ্মী ছিলেন। লোকজন তাঁর মধুর বাণী এবং সুমিষ্ট ওয়ায ঘন্টর পর ঘন্টা মোহিত হয়ে শুনত। তাঁর ওয়াযে এমন এক মোহনীয় শক্তি ছিল যা শুনে সবাই লাভবান হতো।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য, কামালাতের উচ্চ মাকামে উন্নীত হবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, এমন কি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মুরাকাবা-মুশাহাদারত হন। তিনি এই সময় খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন, এমনকি গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেন। জানা যায়, অনেক বছর তিনি বাগদাদ শরীফের বাইরে একটা টিলার উপর একটা জীর্ণ কুটিরে অবস্থান করে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।
ইন্তিকালঃ
=====
৫৬১ হিজরি মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস্ সানি সোমবার রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তিকাল করেন। যে কারণে এ ১১ বলতে ১১ রবিউস্ সানিকেই বুঝানো হয় এবং এ ১১ এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে যায় যে, অনেক খানকা শরীফে এগারো শরীফ বা গিয়ারী শরীফও অনুষ্ঠিত হয়। তিনি শুয়ে আছেন বাগদাদ নগরীতে। বাগদাদ সূফী জগতের বিলায়তের রাজধানী। বাগদাদ গাউসুল আজমের কারণে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
গাউসুল আযম এবং কাদিরীয়া তরিকার ওপর বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় গাউসুল আযমের কয়েকখানি গ্রন্থের তরজমা বের হয়েছে। গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির গ্রন্থরাজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ফতহুল গায়েব, ফতহুর রাব্বানী, সিররুল আসরার, গুনিয়াতুত্ তালেবীন, কাসিদায়ে গাউসিয়া প্রভৃতি।
ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদানঃ
=================
বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সুফিয়ায়ে কেরামের ভূমিকা সর্বজনবিধিত। তাঁরা তাঁদের উন্নত চরিত্র, উদার ভাবধারায় এত সহজে মানুষের অন্তরকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা শক্তি ও তলোয়ারের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি ও হবেও না।
মানবজাতির হেদায়তের ক্ষেত্রে তাদের দু’টি দিক সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। একদিকে আদর্শ, উন্নত চরিত্র, উদারতা, সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা, বিন¤্র মনোভাব, উত্তম মুয়ামালা ইত্যাদিতে তাঁরা ছিলেন অদ্বিতীয়, ফলে তাঁরা খুব সহজে খুব দূরের মানুষকে কাছে আনতে এবং শত্রুকেও বশ করতে সক্ষম ছিলেন। যেমনটি দেখা যায় হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনে।
অন্যদিকে তাঁদের ওয়াজ-নসিহতের মাহফিল ও বৈঠক, যাতে মুসলিম ও অমুসলিম সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল উম্মুক্ত। ফলে তাঁদের আলোচনা দ্বারা মানুষের জীবনে এক আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি।
প্রাথমিকভাবে মজলিস আরম্ভ হয়েছিল দুই তিন জনকে নিয়ে, কিন্তু তাঁর মধুরবাণী ও সুমিষ্ট ওয়াজ-নসিহতে মানুষ বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক আসতে শুরু হলো। এমনকি তাঁর এক একটি মজলিসে সত্তর হাজারেরও অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করতো। তাঁর মাদরাসায় বসার জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা বিধায় বাগদাদের মহাসড়কে তাঁকে ওয়াজ-নসিহত করতে হতো। এভাবে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর মানুষকে হেদায়ত করেন। ‘ফলে তাঁর এমন কোনও মজলিস ছিলনা যেখানে অসংখ্য বিধর্মী ইসলাম গ্রহণ করতো না। পাশাপাশি অসংখ্য ডাকাত, খুনি, পাপাচারী ও অপরাধীতো আছেই যাঁরা তাঁর হাতে তাওবা করে, সঠিক পথে ফিরে আসতো। [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৯]
আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত এ অনুগ্রহের কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন ‘‘আমার হাতে পাঁচ হাজারেরও অধিক ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করেছেন।’’ [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৮]
গবেষক জামালুদ্দিন ফালেহ্ জিলানী তাঁর ‘ইমাম আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি নামক কিতাবে লিখেছেন সবচেয়ে প্রাচীনতম তরিকা হলো কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার প্রবর্তকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তিনি এমন একটি প্রজন্ম গঠনে মহান ভূমিকা রেখেছেন যারা বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফকে খ্রিস্টান দখলদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ কাদেরিয়া তরিকার অনুসারীদের অন্যতম ছিলেন বিম্ববিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, আবদুল কাদের জাজায়েরী, ওমর মুখতার, জেনারেল আবদুর রহমান, রফিক আলী আল জিলানীসহ এ উম্মতের গৌরব করার মত আরও অনেকেই।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শুধুমাত্র উন্নত আদর্শ, উদারতা, মানবপ্রেম, ওয়াজ নসিহত ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেননি বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাঁর খলীফা, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে এমন একটি জামাত গঠন করেন যারা দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। যাঁদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের একটি দল হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি জীবদ্দশায় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন।
হযরত আবদুল কাদের জীলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সরাসরি খলিফা হলেন হযরত বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, যিনি বড়পীর সাহেবের জীবদ্দশায় এবং তাঁরই নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং বাংলাদেশেই শাহাদত বরণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম খানকায়ে কাদেরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।
অনুরূপভাবে হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি যিনি গাউসে পাকের পৌত্র (নাতী) ছিলেন, রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার করেন।
অধ্যাডক ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান তাঁর রচিত ‘ইনতেশারুল ইসলাম ফিল ক্বাররাহ্ আল আফরিকীয়্যাহ্’ গ্রন্থে বলেন, ‘আফ্রিকা মহাদেশে ইসলাম প্রচারে যে তরিকার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হলো তরীকায়ে কাদেরিয়া। অনুরূপভাবে ড. আবদুর রহমান জাকী তাঁর রচিত ‘আল মুসলেমুনা ফি আল আলাম আল ইয়াউম’ নামক কিতাবে একই মন্তব্য করেন।
মাসিক আল ইসলাম ওয়াত তাসাউফ (জানুয়ারি ১৯৬১) তার রিপোর্ট উল্লেখ করেছে সোমালিয়াতে সর্বপ্রথম যে তরিকাটি প্রবেশ করে সেটি হলো কাদেরিয়া তরিকা। ফরাসী প্রাচ্য গবেষক ফানসান মুনতাই ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি মরক্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধে বলেন, ‘চীনের ইনান নামক প্রদেশে একটি মাজার দেখা যায় যার ফলকে লিখা আছে। আবদুর রাজ্জাক বাগদাদির নাম, যিনি দ্বাদশ খ্রিস্টীয় শতাব্দীতে চীনে ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির পৌত্র (নাতী) এবং চীনে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী।’’
হেলী কারবার দানকোচ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোকাজের মুসলমানগণ এখনও হানাফী মাযহাব এবং কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী-কমিউনিউজিয়ামের শাসন ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁদেরকে তাঁদের ঘরে কাদেরিয়া তরিকার ওয়াজিফা পাঠ করতে শুনেছি।
বিশ্বজুড়ে কাদিরয়া তরিকা:
================
শরীয়ত তরীকত হাক্বীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে যে ইলম সম্বলিত ও বিকশিত হয়েছে তাকে বলা হয় ‘ইলমে তাসাওউফ’ বা তাসাওউফ বিজ্ঞান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই এলমে তাসাওউফ চর্চা সূচিত হয়েছে।
কুরআন মজীদে যে তাযকীইয়ায়ে নফস এবং হাদীস শরীফে যে ইহসানের কথা বলা হয়েছে সেটাই মূলতঃ তাসাওউফের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাসাওউফ চর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতি কালক্রমে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিন্যাসিত হয়েছে যেগুলো ত্বরীকা নামে পরিচিত। কাদেরিয়া তরিকা তরিকাসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত।
তিনি ইলমে তাসাওউফ তথা শরীয়ত, তরীক্বত ও হাক্বীক্বত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইসলামের এ অনন্য বিজ্ঞানকে আরও সহজে চর্চার সুবিধার্থে এক আলোচিত ধারার পদ্ধতি বিন্যাস করেন। এটা কাদেরিয়া তরীকা নামে পরিচিতি লাভ করে।
তিনি ইলমে তাসাওফের আলখেল্লা পরা তাঁর কালের সমস্ত বাতিল ফিকাগুলোকে চিহ্ণিত করে তাদের সান্নিধ্যে না যাবার জন্য আহ্বান জানান। তিনি কি কি কারণে ঐ সমস্ত ফিরকাগুলো বাতিল তাও উল্লেখ করে পুস্তক লিখে তা জনগণের মধ্যে প্রচার করেন।
ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরীকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরীক্বা হিসেবে বিবেচিত হয় গাউসুল আযম কর্তৃক বিন্যাসকৃত কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরীকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে গাউসুল আযমের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে। কাদেরিয়া তরিকা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু খানকা গড়ে উঠেছে।
কাদেরিয়া তরিকা প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। এটাই শ্রেষ্ঠ তরিকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরিকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী অসংখ্য খানকা শরীফ রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে। বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার সূচনা হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে কাদেরিয়া তরিকা:
==========================
বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। যতদূর জানা যায় হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি রাজশাহীর শাহ্ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলায়হি, পশ্চিম বাংলার হযরত মনসূর বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলে এ তরীকার ব্যাপক প্রসার ঘটান।
বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি:
=========================
যে ক’জন প্রখ্যাত সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ওলি। ভারতে মধ্যযুগে যে ক’জন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারে উদ্দেশ্যে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান।
খোরাসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদরাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাহচর্যে আসেন এবং তাসাওফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।
তিনি প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরে বাবা আদম শহীদ হন। শহীদ হওয়ার পর তাকে রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি:
===============================
রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যাদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাদের অন্যতম। ওলীকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রিয়তম পৌত্র হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ ছিলেন সে মহান সাধক যিনি রাজশাহীর মত অনগ্রসর স্থানে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছিলেন। তৎকালীন মহাকালগড়ে (বর্তমানে রাজশাহী) দেও রাজাদের অন্যায়-অনাচার, অবিচার ও নানা কুসংস্কার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। বিশেষ করে মানুষ বলি দেয়ার মত নিষ্ঠুর কাজে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলের মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে শান্তির নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাঁর নাম শাহ্ মাখদুম জালাল উদ্দীন রূপোশ। অন্যত্র তাঁর নাম আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ‘তাঁর নাম সায়্যিদ আবদুল কুদ্দুস। শাহ্ মাখদুম রূপোশ নামে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। ‘শাহ্’ মাখদুম, ‘রূপোশ’ এগুলো তাঁর লকব বা উপাধি।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ৬১৫ হিজরির ২ রজব মোতাবেক ১২০৮ খৃস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে পিতৃগ্রহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি। হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির ২৭ পুত্রের একজন। হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হির দ্বিতীয় পুত্র।
No comments