ইসলামে শিশুর অধিকার


জুমার খুতবা
============
৪র্থ জুমা, ২২ জুমাদা আল উলা, ১৪৩৯হি:, 09 February ২০১৮ সাল

ইসলামে শিশুর অধিকার
***********************************************
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। #
——————————————————————————————————–
بسم الله الرحمن الرحيم

আজকের শিশু আগামী প্রজন্মের নাগরিক। আজ যারা ছোট, কাল তারা হবে বড়। ভবিষ্যতে তারাই হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। তাই এ শিশু-কিশোরেরা অনাদর ও অবহেলায় অধিকার বঞ্চিত হয়ে বড় হলে ভবিষ্যতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নেমে আসবে চরম অশান্তি ও বিশৃংখলা।

শিশুরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনেও শিশুদেরকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, সৌভাগ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ সুসংবাদ ও চোখের প্রশান্তিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

সন্তানকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যের ঘোষণা পবিত্র কোরআনে এসেছে-এরশাদ হচ্ছে;
المالُ وَالبَنونَ زينَةُ الحَياةِ الدُّنيا وَالباقِياتُ الصّالِحاتُ خَيرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوابًا وَخَيرٌ أَمَلًا ﴿٤٦﴾
“ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।” (কাহ্ফ-৪৬)।
يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ اسْمُهُ يَحْيَىٰ لَمْ نَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا (مريم-07)
“হে যাকারিয়া! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এক পুত্র সন্তানের যার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতোপূর্বে আমি আর কাউকে এই নামধারী করিনি।”(মারইয়াম-৭)।

সন্তান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য এক বিশেষ দান ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ (النحل-16-17)
‘আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের পুত্র ও পৌত্রদের আর রিযিক দিয়েছেন তোমাদের উত্তম বস্ত্ত থেকে। তবুও কি তারা বাতিলকে বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নে‘মত অস্বীকার করবে’? (নাহল ১৬/৭২)।

আজকাল এটা খুব উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সন্তান-সন্তুতি এখন আর পিতা-মাতার জন্য আনন্দের কোন বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে না। যদিও আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে তাদেরকে পরম রহমতের বিষয় বলে বর্ণনা করেছেন। আর এটা ঘটছে পিতা-মাতার চরম অবহেলা ও অবিবেচনার জন্য।

কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا ﴿٧٤﴾( سورة الفرقان، الآية: 74.)
‘এবং যারা কামনা করে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দান করো এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি যারা হবে আমাদের জন্য নয়নের শীতলতা এবং আমাদেরকে করো মুত্তাকীদের ইমাম।’(সূরা ফুরকানের ৭৪ নাম্বার আয়াত)

ইসলাম শিশু-কিশোরদের অনেক অধিকার দিয়েছে। শিশু-কিশোরদের অধিকার রক্ষায় প্রায় দেড় হাযার বছর আগে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সুমহান জীবনাদর্শের মধ্যে শিশু-কিশোরদের জন্য রেখে গেছেন অধিকার সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। তাদের জন্ম থেকে শুরু করে জীবন চলার পথে আরো অনেক অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। তাই শিশু কিশোরদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আচরণ ছিল অধিক মমতাপূর্ণ।

শিশু অধিকার বলতে কি বুঝায়:
———————————
কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কখন থেকে একটি শিশুর অধিকার শুরু হয়? তাহলে মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস অনুসারে বলবো, এটি শুরুর আগ থেকেই শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, একটি শিশুর জন্মের আগ থেকেই তার অধিকার শুরু হয়ে যায়।

তাই ইসলামে শিশু অধিকার বলতে বুঝায়, যে অধিকারসমূহ শিশু মায়ের গর্ভে থাকা থেকে শুরু করে কৈশোর বা শৈশব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

আমরা যখন আমাদের জন্য একজন জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচন করতে যাই তখন থেকেই শিশুর প্রতি আমাদের দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। কেননা, শিশুদেরও অধিকার রয়েছে অধিকতর সৎ এবং মহৎ মা-বাবা লাভ করার; একজন ভালো মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়ার, একজন মমতাময়ী নারীকে মা হিসেবে পাওয়ার; যারা তাদেরকে ভালোবাসবে এবং সত্যিকার ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। পিতা-মাতা যদি সৎ চরিত্রবান না হন তাহলে পৃথিবীতে শিশুর আসা বা জন্ম লাভ করাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

হযরত ওমর রা. এর মতে, শিশু অধিকার শিশু জন্মের পূর্ব থেকেই শুরু হয়ে যায়। একবার হযরত ওমর রা. -এর শাসনামলে তাঁর কাছে শিশু অধিকার সর্ম্পকিত একটি অভিযোগ এলে তিনি শিশুর তিনটি হক বা অধিকারের কথা বলেছেন।

১ম অধিকার হল:
——————
তার পিতা একটা ভাল মায়ের ব্যবস্থা করবে। এটা এজন্য যে, ভাল মায়ের গর্ভে ভাল সন্তান হয়। তাই ভাল সন্তান চাইলে তার জন্য একটা ভাল মায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

২য় অধিকার হল:
——————-
সন্তানের ভাল নাম রাখতে হবে। কেননা ভাল নামের ভাল প্রভাব হয়, খারাপ নামের খারাপ প্রভাব হয়। এজন্যেই ইসলাম ভাল অর্থপূর্ণ নাম রাখতে গুরুত্বারোপ করেছে। রাসূল সা. কাছে এমন কেউ যদি আসতেন যার নামের অর্থ খারাপ। তিনি তার ঐ নাম পরিবর্তন করে একটা ভাল অর্থপূর্ণ নাম রেখে দিতেন।

৩য় অধিকার হল:
——————
পিতা-মাতা তাকে দ্বীন শিক্ষা দিবে। ইসলামের চেতনা আসে এ ধরনের কথাবার্তা শিখাতে হবে।
সন্তানকে সর্ব প্রথম যে কথা শিখানো উত্তম তা হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। জন্মের শুরু থেকেই যেন তার মধ্যে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের কথা এবং দ্বীনের জরুরী এবাদতের কথা তার ভেতরে প্রবেশ করে, এজন্য শিশুকে সর্বপ্রথম ডান কানে আযানের শব্দগুলো এবং বাম কানে ইকামাতের শব্দগুলো শোনানো সুন্নত। এরপর শিশুকে পদে পদে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের কথা আদব কায়দা শিখাতে হবে।
রেওয়াত আছে:
مثل الذي يتعلم في صغره كالنقش على الحجر ، ومثل الذي يتعلم في كبره كالذي يكتب على الماء ، (البيهقي)
অর্থাৎ শিশু বয়সে ইলম শিক্ষা পাথরের উপরঅংকনের মত স্থায়ী, আর বৃদ্ধ বয়সে ইলম শিক্ষা পানির উপর দাগ টানার মত অস্থায়ী [বায়হাকী ও মাকাসেদুল হাসানা]।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
عَنْ أَيُّوبَ بْنِ مُوسَى ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدَهُ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ ” . رواه الترمذي.
“মাতা-পিতা সন্তানের জন্য যা রেখে যায় বা যা উপহার দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল উপহার হল উত্তম আদব।“(তিরমিযী)

নবজাতকের কানে আজান দেওয়া:
————————————-
প্রত্যেক নবজাতকের সর্বপ্রথম অধিকার হল জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরেই তার কানে আযানের শব্দমালা উচ্চারণ করা। শিশুকে সর্বপ্রথম যে শব্দগুলো শুনতে হবে তা হল, আল্লাহ তার প্রভু এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার রাসূল।
عن عبيد الله بن أبي رافع، عن أبي رافع قال: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم أذن في أذن الحسن بن علي حين ولدته فاطمة (أبو داود (5105)، والترمذي (1514)، وأحمد (6/ 9، 391)، والبيهقي (9/ 305(
আবু রাফায়ী (রা.) বর্ণনা করেন, যখন ফাতিমা (রা.) হাসান (রা.) কে প্রসব করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কানে আজান দেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
عن ابن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم أَذَّن في أُذن الحسن بن علي يوم ولد، وأقام في أذنه اليسرى (البيهقي في (شعب الإيمان عن الحسن بن علي أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: “مَن وُلد له مولود، فأذّن في أُذنه اليمنى، وأقام في أذنه اليسرى، رفعت عنه أم الصبيان” (البيهقي في (الشعب) (8619)، (8620)
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবজাতকের ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামতের আদেশ দিয়েছেন। (তাবরানি) হাদিস শরীফে আরও বর্ণিত আছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ((إذا نودي بالصلاة أدبر الشيطان وله ضراط حتى لا يسمع التأذين، فإذا قضى التأذين، أقبل، فإذا ثوِّب بالصلاة، أدبر فإذا قضى التثويب، أقبل، حتى يخطر بين المرء ونفسه، فيقول: اذكر كذا، اذكر كذا، لما لم يكن يذكر، حتى يظل الرجل لا يدري كم صلى)) البخاري (1/151) [برقم (608)]، ومسلم (1/291) [برقم (389)]. (ق.)
যখন আযানের শব্দগুলো উচ্চারণ করা হয় তখন আযানের শব্দ যে পর্যন্ত শুনা যায়, সে পর্যন্ত শয়তান পলায়ন করে থাকে। (বুখারি, মুসলিম) অতএব, নবজাতকের কানে আযানের বাক্যগুলোর উচ্চারণ নবজাতকের জন্য শয়তানের অনিষ্টতা থেকে হেফাজতের মাধ্যমও বটে।

তাহনিক ও দোয়া:
——————
নবজাতকের তৃতীয় সুন্নত কাজ হলো ‘তাহনিক’ করা, অর্থাৎ খেজুর চিবিয়ে সে চর্বিত খেজুরের কিছু অংশ নবজাতকের মুখে লাগানো, যাতে এর কিছু রস তার পেটে পৌঁছে যায়। খেজুর না পেলে মিষ্টিদ্রব্য দিয়েও তাহনিক করা যায়। তাহনিক’-এর প্রক্রিয়াটিকে নিম্নোক্ত হাদিসে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
قول أسماء بنت أبى بكر حين حملت بعبد الله بن الزبير بمكة قالت: فخرجت وأنا متم (أى أكملت الشهر التاسع من الحمل)، فأتيت المدينة، فنزلت بقباء فولدت بقباء، ثم أتيت رسول الله (صلى الله عليه وسلم)، فوضعته فى حجره، ثم دعا بتمرة، فمضغها، ثم تفل فى فيه، فكان أول شيء دخل جوفه ريق رسول الله (صلى الله عليه وسلم)، ثم حنكه بالتمرة، ثم دعا له، فبرك عليه، وكان أول مولود وُلد فى الإسلام، ففرحوا به فرحًا شديدًا، لأنهم قيل لهم: إن اليهود قد سحرتكم فلا يولد لكم.
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, যখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) জন্ম গ্রহণ করেন তিনি তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যান। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোলে ওঠিয়ে নেন। তিনি একটি খেজুর চিবান এবং চর্বিত খেজুরের একটি অংশ আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের মুখে রাখেন। অতঃপর তিনি তার জন্যে দোয়া করেন। (বুখারি, মুসলিম)
عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يُؤتَى بالصبيان فَيُبَرِّك عليهم ويحنكهم . رواه البخاري ومسلم .
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, লোকেরা তাদের সদ্যজাত শিশুদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে নিয়ে আসত। তিনি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন এবং তাহনীক’ ক্রিয়া সম্পাদন করতেন। (মুসলিম)
عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِي اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: وُلِدَ لِي غُلامٌ فَأَتَيْتُ بِهِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَمَّاهُ إِبْرَاهِيمَ فَحَنَّكَهُ بِتَمْرَةٍ) رواه البخاري ومسلم .(
এই হাদিস আমাদেরকে নির্দেশনা দেয় যে, আমাদের নবজাতক শিশুদেরকে পরিবারের একজন বয়স্ক ও দীনদার লোকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি তখন নবজাতকের জন্য দোয়া করবেন এবং তাহনীক’ ক্রিয়া সম্পাদন করবেন। এটি এমন একটি সুন্নাত যার উপর বর্তমানে আমল বিরল। আমাদের প্রিয় নবিজীর এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে আমাদেরকে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে।

আকিকা প্রদান:
—————-
‘আকিকা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নবজাতকের মাথার চুল। শরিয়তের পরিভাষায় নবজাতকের সেই চুল ফেলার দিনে বিশেষ শর্তাবলির প্রতি লক্ষ রেখে যে পশু জবাই করা হয়, এটিকে ‘আকিকা’ বলে। এ আকিকা ইসলামের একটি তাৎপর্যমণ্ডিত সুন্নত। সাধ্য সাপেক্ষে পালন করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুর উত্তম আদর্শময় নিরাপদ জীবন আকিকার দায়ে আবদ্ধ থাকে। আকিকার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন,
وعن سمرة قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: الغلام مرتهن بعقيقته يذبح عنه يوم السابع ويسمى، ويحلق رأسه. رواه الترمذي وأبو داود وابن ماجه، وقال الترمذي:حسن صحيح.
‘প্রতিটি শিশু তার আকিকার দায়ে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করা হবে, তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথা মুণ্ডিত করা হবে।’ (তিরমিজি, আহমাদ ও নাসায়ী)
فعن عائشة-رضي الله عنها-قالت: كانوا في الجاهلية إذا عقوا عن الصبي، خضبوا بطنه بدم العقيقة، فإذا حلقوا رأس المولود وضعوها علي رأسه، فقال النبي ( :”اجعلوا مكان الدم خلوقًا)ابن حبان( عن بريدة الأسلمي-رضي الله عنه-قال: “… فلما جاء الإسلام كنا نذبح شاة، ونحلق رأسه، ونلطخه بالزعفران”[أبو داود].
বুরাইদাহ (রা.) বর্ণনা করেন, অজ্ঞতার যুগে আমাদের রীতি ছিল, যখন কোন শিশু জন্মগ্রহণ করত তখন তার পরিবার কর্তৃক একটি ছাগল জবাই করা হত এবং এর রক্ত দ্বারা নবজাতকের মাথা রঞ্জিত করে দেয়া হত। যখন থেকে আমরা মুসলমান হলাম, নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিনে আমরা একটি ছাগল জবাই করি, তার মাথা মুন্ডন করি এবং জাফরান দ্বারা তা আবৃত করে দেই। (আবু দাউদ)
ولقوله (:”من أحب أن ينسك عن ولده فليفع[أحمد وأبو داود]. حديث سمرة عن النبي ( أنه قال: “كل غلام رهينة بعقيقته، تذبح عنه يوم سابعه، ويسمي فيه، ويحلق رأسه”[رواه الخمسة وصحهه الترمذي] وقالوا: إن الولد محبوس عن الشفاعة لوالديه حتى يعق عنه، فعن أم كرز الكعبية، أنها سألت رسول الله ( عن العقيقة، فقال:”نعم عن الغلام شاتان، وعن الأنثي واحدة، لا يضركم ذكرانًا كن أو إناثًا”[أحمد والترمذي وصححه]

উম্মে কারাজ (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, নবজাতক ছেলে হলে দুটি ছাগল এবং মেয়ে হলে একটি ছাগল জবাই করতে হবে। ছাগল চাই পুরুষ জাতীয় হোক কিংবা স্ত্রী জাতীয়। (আবু দাউদ, নাসায়ী)

হাদিসের ভাষ্যকাররা বলেন, ছেলের জন্য দুটি ছাগল জবাই করা এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল জবাই করা মুস্তাহাব। যে কোন নবজাতকের জন্য কেবল একটি মাত্র ছাগল জবাই করারও অনুমতি রয়েছে। নিম্নলিখিত হাদিস থেকে তা বুঝা যায়:
عن ابن عباس أن رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم عق عن الحسن والحسين كبشًا كبشًا [أبو داود]
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দৌহিত্র হাসান ও হুসাই (রা.) উভয়ের জন্য আকিকা সম্পাদন করেন এবং উভয়ের জন্য একটি করে ছাগল জবাই করেন। (আবু দাউদ)
عن علي بن أبي طالب قال: عق رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الحسن بشاة، وقال: يا فاطمة احلقي رأسه، وتصدقي بزنة شعره فضة، قال: فوزنته فكان وزنه درهماً أو بعض درهم. (رواه الترمذي.)
আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতি হাসান (রা.) এর আকিকা উপলক্ষে একটি ছাগল জবাই করেন। তিনি তাঁর কন্যা ফাতিমাকে ছেলের মাথা মুন্ডিয়ে দিতে বলেন এবং তার চুলের ওজনের সমপরিমাণ রূপা সদকা করতে বলেন। (তিরমিযি)

আকিকা কেবল নবজাতকের অধিকারই নয়, বরং তা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আকিকার গোস্ত পরিবারের সদস্য ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে বিলি বন্টন করা হয়। এটি পুরো সমাজের মধ্যে একটি আনন্দ ও খুশির উপলক্ষ নিয়ে আসে।

নবজাতকের নামকরণ:
———————–
শিশুর আরেকটি মৌলিক অধিকার হলো: তাকে একটি সুন্দর নাম দেয়া। আমাদের সমাজে বর্তমানে এ বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না। প্রায়ই দেখা যায়, ছেলেমেয়েদের অর্থহীন নাম দেয়া হচ্ছে। অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির ওপর খুবই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতাদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে যাতে তারা সন্তানকে একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম উপহার দেয়।

একজন মানুষের ওপর তার নামের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে। সারা জীবন এই নাম তার সাথে থাকে। এমনকি মৃত্যুর পরও তার নাম পৃথিবীতে থেকে যায়। শুধু তাই নয়, তার ছেলেমেয়ে এমনকি অধস্তন বংশধরগণও এই নামটি বহন করে চলে। সুতরাং সন্তানের নাম হেলাফেলার সাথে রাখা উচিত নয়। আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, লোকেরা তাদের পিতৃ পদত্ত প্রকৃত নাম বদল করে নিজেদের পছন্দ মতো নাম রাখছে। কারণ, বাপ-মার দেয়া নামগুলো তাদের পছন্দ নয়, অথবা সে নামগুলো নিয়ে তারা বন্ধু মহলে অস্বস্তি বোধ করে। অতএব, সন্তানের নামটি অবশ্যই অর্থপূর্ণ এবং শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের সুন্দর নাম রাখার জন্য পিতা-মাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
فقد قال صلى الله عليه وسلم:إِنَّكُمْ تُدْعَوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِأَسْمَائِكُمْ وَأَسْمَاءِ آبَائِكُمْ فَحَسِّنُوا أَسْمَاءَكُمْ) [أحمد عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ(
আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের নাম ধরে এবং তোমাদের পিতার নাম ধরে ডাকা হবে। তাই তোমাদের সন্তানদের ভাল নাম রাখো। (আহমদ, আবু দাউদ)
عَنْ أَبِي وَهْبٍ الْجُشَمِيِّ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَسَمَّوْا بِأَسْمَاءِ الأنْبِيَاءِ وَأَحَبُّ الأسْمَاءِ إِلَى اللَّهِ عَبْدُ اللَّهِ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ وَأَصْدَقُهَا حَارِثٌ وَهَمَّامٌ وَأَقْبَحُهَا حَرْبٌ وَمُرَّةُ[النسائي عَنْ أَبِي وَهْبٍ الْجُشَمِيِّ]
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের নামসমূহের মধ্যে আল্লাহর কাছে প্রিয়তম নাম হল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। (মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ থেকে জানা যায় যে, অন্যান্য নবিদের নাম এবং ভাল অর্থবোধক নামসমূহও উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ছেলের নাম রাখেন ইবরাহিম এবং নাতিদ্বয়ের নাম রেখেছেন হাসান ও হুসাইন। এটিও রাসূলের সুন্নাহ যে, যদি কেউ কোন শিশুর একটি খারাপ নাম কিংবা কোন অবাঞ্চিত নাম রাখে তবে তিনি তা পরিবর্তন করে অন্য নাম রাখতেন।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ” غَيَّرَ اسْمَ عَاصِيَةَ ، قَالَ : أَنْتِ جَمِيلَةُ ” . )أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ وَأَبُو دَاوُدَ (
ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন, ওমর (রা.) এর এক কন্যার নাম ছিল আসিয়া এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন জামীলা।
ففي صحيح البخاري عن أبي هريرة رضي الله عنه : أن زينب كان اسمها برة، فقيل: تزكي نفسها فسماها رسول الله -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- زينب » 10 \575 فتح،
অনুরূপভাবে আবু সালামা (রা.) এর এক কন্যার নাম ছিল বাররা। যার অর্থ হল পূণ্যবান। রাসূলুলস্নাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই নামের মধ্যে পূণ্যবানের একটি দাবি রয়েছে। তিনি তা পরিবর্তন করে রাখেন যাইনাব।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَسَمَّوْا بِاسْمِي وَلا تَكَنَّوْا بِكُنْيَتِي) متفق عليه)
ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার নাম অনুসারে তোমাদের ছেলেদের নামকরণ কর, আমার উপনাম অনুসারে নয়; অর্থাৎ, আবুল কাসেম।

মায়ের দুধ আল্লাহর খাস নেয়ামত:
————————————
মায়ের দুধ পান শিশুর জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেই বুকের দুধ খাওয়ানোকে শিশুর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

শিশুর জন্য মায়ের দুধ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট খাদ্য। যার সমমানের কোনো খাবার নেই। মায়ের দুধ যেমন পুষ্টিকর তেমনি বিশুদ্ধ, নিরাপদ, আদর্শ, সর্বশ্রেষ্ঠ খাবার। একটি শিশুর দৈহিক-মানসিক সুষ্ঠু, সুন্দর বিকাশের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান প্রয়োজন তার সব উপাদানই সঠিক মাত্রায়, সঠিক তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ অবস্থায় মজুদ থাকে মায়ের দুধে। তাই জন্মের পর পরই শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর ও উপকারী। যেসব শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় তারা বুকের দুধ বঞ্চিত শিশুদের তুলনায় অধিক স্বাস্থ্যবান হয়, তাড়াতাড়ি বড় হয় এবং অধিকতর স্মার্ট হয়।

এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশই দেননি, সুনির্দিষ্টভাবে সময়কালও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ২৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে,
۞ وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوْلُودٌ لَّهُ بِوَلَدِهِ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَٰلِكَ فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَن تَرَاضٍ مِّنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا وَإِنْ أَرَدتُّمْ أَن تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُم مَّا آتَيْتُم بِالْمَعْرُوفِ وَاتَّقُوا اللَّـهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ﴿ البقرة:٢٣٣﴾
আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ন দু’বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়াবার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়।আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ, পিতার উপর হলো সে সমস্ত নারীর খোর-পোষের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী।কাউকে তার সামর্থাতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন করা হয় না।আর মাকে তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এবং যার সন্তান তাকেও তার সন্তানের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। আর ওয়ারিসদের উপরও দায়িত্ব এই। তারপর যদি পিতা-মাতা ইচ্ছা করে, তাহলে দু’বছরের ভিতরেই নিজেদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে,তাতে তাদের কোন পাপ নেই, আর যদি তোমরা কোন ধাত্রীর দ্বারা নিজের সন্তানদেরকে দুধ খাওয়াতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্তকৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও তাতেও কোন পাপ নেই। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে,আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ অত্যন্ত ভাল করেই দেখেন। (সূরা আল বাকারা,আয়াত ২৩৩ )

এ প্রসঙ্গে সূরা আহকাফে আল্লাহ আরও বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴿الأحقاف:١٥﴾
আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থে?র বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর,যাতে আমি তোমার নেয়ামতের শোকর করি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি তওবা করলাম এবংআমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম।(সূরা আহকাফ:15)

বুকের দুধ নিশ্চিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যেমন শিশুর অধিকার নিশ্চিত করেছেন, তেমনি নিশ্চিত করেছেন মায়ের অধিকার। এমনকি মায়ের অবর্তমানে বা অক্ষমতার কারণে যে মা শিশুকে দুধ পান করাবে সেই দুধ মায়ের অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে।

সুতরাং শুধু মায়ের কর্তব্য হিসেবেই নয়, ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেও শিশুদের বুকের দুধ পান করানো মায়েদের উচিত। মায়ের দুধ শিশুর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত।

শিশুর সর্ব প্রথম শিক্ষা:
————————
পিতামাতা তাদের নবজাতককে তাদের জীবনের প্রথম কথা হিসেবে শিক্ষা দিতে হবে কালিমা তাইয়িবা “লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ“ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের ছেলেমেয়েদেরকে জীবনের সর্বপ্রথম উচ্চারিত শব্দ হিসেবে লা ইলাহা ইল্লাহ’ (কালিমা তাইয়িবা) শিক্ষা দাও এবং মানুষকে তাদের মৃত্যুর পূর্বে অনুরূপ বলতে নির্দেশনা দাও। (বায়হাকি)

এই হাদিসটিতে প্রথমত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দিয়েছেন যে, পিতামাতা তাদের নবজাতকের কানে এ কালিমা উচ্চারণ করে শুনাবে। দ্বিতীয়ত: তাদের ছেলেমেয়েদেরকে তাদের জীবনের প্রথম কথা হিসেবে তা শিক্ষা দিবে। তৃতীয়ত: আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের জীবনের সর্বশেষ কথা হিসেবে তা আবৃত্তি করতে। কারণ কানে শুনা প্রথম শব্দ ও জিহবায় উচ্চারিত প্রথম শব্দ মানুষের বেড়ে ওঠা ও ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব ফেলে।

উত্তম গুণাবলী শিক্ষা দান:
————————–
একজন মুসলমান মনে করে, ইহজীবন হল শাশ্বত পরকালীন জীবনের পথে একটি মনজিল। তাই তাকে এই ইহকালীন জীবনের চেয়ে অনন্ত পরকালীন জীবনের সফলতার বিষয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে। এজন্যে পিতামাতাকে তাদের সন্তান-সন্ততির ইহকালীন জীবনের সফলতার পাশাপাশি তাদের পরকালীন জীবনের সফলতার প্রতিও অধিক মনোযোগী হতে হবে। পিতামাতার উচিৎ হবে তাদের সন্তান-সন্ততিকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও তারবিয়াত দান করা এবং তাদের পরকালীন জীবনের শ্বাশ্বত সফলতাকে নিশ্চিত করা।
عن ابن عباس : أكرموا أولادكم واحسنوا أدبهم (رواه ابن ماجة)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সন্তান-সন্ততিকে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দান করবে এবং তাদেরকে সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত করবে। (আবু দাউদ)

দান করা একটি সওয়াবের কাজ। কিন্তু ছেলেমেয়েদেরকে সৎ চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেওয়া ইসলামে তার চেয়েও অধিক সওয়াবের কাজ।

হজরত সাদ ইবনুল আছ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لأَنْ يُؤَدِّبَ الرَّجُلُ وَلَدَهُ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَتَصَدَّقَ بِصَاعٍ) سنن الترمذي » كتاب البر والصلة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم » باب ما جاء في أدب الولد)
কোন ব্যক্তির তার সন্তানকে সৎ চারিত্র ও গুণাবলী শিক্ষা দেয়া এক সা (ওজন পরিমাপের একটি) পরিমাণ দান করার চেয়েও উত্তম। (তিরমিযি)

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَّ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ (البخاري ومسلم)
প্রত্যেক নবজাতক শিশুই ফিতরাত’ (ইসলাম) এর উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে খৃস্টান, ইয়াহুদী কিংবা অগ্নিপুজারী করে গড়ে তোলে। অতঃপর তিনি এই কুরআনের আয়াতটি তেলাওয়াত করে শুনান-
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّـهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿الروم:٣٠﴾
অতএব, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্য নিজকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি (ফিতরাত), যে প্রকৃতির উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’- রূম, ৩০:৩০ (বুখারি, মুসলিম)

আমদের সবার এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শিশুরা হচ্ছে মাতা-পিতার নিকট রক্ষিত আমানত। আর এ আমানত সম্পর্কে আখেরাতে তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। এ দায়িত্ব পালনের জন্য শেষ বিচারের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যাপারে মহানবী (সা) বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
‘তোমাদের সবাই ধর্মোপদেশক এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দলের বা নির্ভরশীলদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। (বুখারি, মুসলিম)

শিশুদের সালাম শিক্ষা দেওয়া:
——————————-
আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সৎ গুণাবলী শিক্ষা দেয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হল তাদের সামনে উদাহরণ পেশ করা। যখন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সালাম করি তখন আমরা তাদের প্রতি মর্যাদা ও সম্মান দেখায়। এমতাবস্থায় আমরা তাদের কাছ থেকেও অনুরূপ আচরণ আশা করতে পারি।
عن أنس بن مالك رضي الله عنه أنه مر على صبيان فسلم عليهم وقال كان النبي صلى الله عليه وسلم يفعله (البخاري ومسلم)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) কিছু ছেলেমেয়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন এবং তাদেরকে আস সালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলেন। আর বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। (বুখারি, মুসলিম)
عن ابن عباس : أكرموا أولادكم واحسنوا أدبهم (رواه ابن ماجة)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর এবং তাদেরকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীতে শোভিত কর। (ইবনে মাজাহ)

ছেলেমেয়েদের প্রতি সম্মান দেখানোর একটি উপায় হল তাদেরকে ঠিক সেভাবে শুভেচ্ছা জানানো যেভাবে আমরা বড়দেরকে শুভেচ্ছা জানাই। সম্মান প্রদর্শন বলতে এও বুঝায় যে, পরিবার তাদের বিশেষ অধিকার ও সমাজে তাদের বিশেষ অবস্থানের মূল্যায়ন ও তার স্বীকৃতি প্রদান করবে।


মিথ্যা ওয়াদা না করা:
———————–
শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি একবার কোনো খারাপ ধারণা প্রবেশ করতে পারে, তবে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে থেকে যায়। তাই নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَامِـــرٍ أَنَّهُ قَالَ: دَعَتْنِي أُمِّي يَوْمًا وَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَاعِدٌ فِي بَيْتِنَا، فَقَالَتْ: هَا تَعَالَ أُعْطِيكَ، فَقَالَ لَهَا رَسُــــولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : « وَمَا أَرَدْتِ أَنْ تُعْطِيهِ ؟».قَالَتْ: أُعْطِيهِ تَمْرًا، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : « أَمَا إِنَّكِ لَوْ لَمْ تُعْطِهِ شَيْئًا كُتِبَتْ عَلَيْكِ كِذْبَةٌ ».( رواه أبو داود (1588 ح4991) و ابن أبي شيبة (5/236) ، وأحمد (3/447)، والبخاري في التاريخ الكبير (5/11) والبيهقي في السنن (10/198) وسَمّى مولى عبدالله بن عامر زيادًا، وله شاهدان :حديث أبي هريرة – رضي الله عنه(
আব্দুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে বসা ছিলেন। এমন সময় আমার মা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে কিছু দেয়ার ওয়াদা দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি দিতে ইচ্ছা করেছেন? আমার মা জানালেন যে, তিনি আমাকে একটি খেজুর দিতে ইচ্ছে করেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, যদি তুমি একটি মিথ্যা ওয়াদা দিয়ে তোমার সন্তানকে আহবান কর, তবে তা তোমার আমল নামায় একটি মিথ্যা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে। (মুসলিম)

নামাজের আদেশ প্রদান:
————————
আমাদের অধিকাংশ অভ্যাসই সাত থেকে দশ বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে। যদি পিতামাতা এ সময় তাদের ছেলে মেয়েদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিতভাবে আদায়ের শিক্ষা প্রদান করে, আশা করা যায় তা তাদের জীবনে স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হবে। কোরান মাজিদে এরশাদ হয়েছে:
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّـهِ أَكْبَرُ وَاللَّـهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ﴿العنكبوت: ٤٥﴾
“আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামায কায়েম করুন। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্যথেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।“(আনকাবুত:45)

অনুরূপ নামাজ আমাদের সন্তানদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবে এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। আমর ইবনে শুআইব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ»، ) أبو داود والحاكم)
তোমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সাত বছর হলে নামাজের আদেশ প্রদান কর এবং তারা দশ বছর বয়সে উপণীত হলে এজন্য তাদেরকে প্রহার কর (যদি তারা নামাজ না পড়ে) এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। (আবু দাউদ)

এই হাদিসটি আরও বলে যে, একটি শিশু যখন দশ বছর বয়সে উপণীত হয় তখন তার একটি পৃথক বিছানা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। পাশাপাশি তা আমাদেরকে ইসলামের সৌন্দর্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমাদের জীবনের বাহ্যিক দিকের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক দিকের প্রতিও নির্দেশনা প্রদান করে।

কোরান মাজিদ শিক্ষা দেওয়া:
——————————
পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদেরকে কোরান মাজিদ শিক্ষা দেওয়া এবং কোরান মাজিদের যথার্থ জ্ঞান দান করা। মুআয জুহাইনি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ زَبَّانِ بْنِ فَائِدٍ عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذٍ الْجُهَنِيِّ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ أُلْبِسَ وَالِدَاهُ تَاجًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ضَوْءُهُ أَحْسَنُ مِنْ ضَوْءِ الشَّمْسِ فِي بُيُوتِ الدُّنْيَا لَوْ كَانَتْ فِيكُمْ فَمَا ظَنُّكُمْ بِالَّذِي عَمِلَ بِهَذَا (وخرج أبوداود في سننه)
যে ব্যক্তি কোরান মাজিদ শিক্ষা করবে এবং তার নির্দেশনা মেনে চলবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিবসে তার পিতামাতাকে তাজ পরিধান করাবেন। যার উজ্জ্বলতা সূর্য থেকেও অধিক হবে। রাসূলুলস্নাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করে বলেন, তার নিজের জন্য তোমরা কি প্রতিদান আশা কর? (আবু দাউদ, আহমদ)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” حَامِلُ الْقُرْآنِ إِذَا عَمِلَ بِهِ فَأَحَلَّ حَلَالَهُ، وَحَرَّمَ حَرَامَهُ يُشَفَّعُ فِي عَشَرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُمُ النَّارُ ) ” شعب الإيمان للبيهقي .(
যে ব্যাক্তি কোরান মাজিদ মুখস্ত করবে, তার হালালকে হালাল জানবে, হারামকে হারাম জানবে, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ তাআলা এমন দশ ব্যাক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গিয়েছিল। (আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, দারেমি)

ছেলে-মেয়ের প্রতি ভালবাসা ও দয়া:
———————————————-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” الْخَلْقُ كُلُّهُمْ عِيَالُ اللَّهِ ، فَأَحَبُّ خَلْقِهِ إِلَيْهِ أَنْفَعُهُمْ لِعِيَالِهِ
সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর কাছে তারাই সবচেয়ে প্রিয় যারা তার পরিজনের প্রতি সদয় আচরণ করে। (বায়হাকি, যয়ীফ)

এই হাদিস আমাদেরকে কেবল নিজেদের ছেলেমেয়ের প্রতি নয়, বরং ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল নির্বিশেষে সকল ছেলেমেয়ের প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা দেয়।
عن عائشة رضي الله عنها قالت جاء أعرابي إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال تقبلون الصبيان فما نقبلهم فقال النبي صلى الله عليه وسلم أوأملك لك أن نزع الله من قلبك الرحمة (صحيح البخاري : كتاب الأدب , باب رحمة الولد وتقبيله ومعانقته)
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একজন আরব বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাচ্চাদের চুমু দিতে দেখে বিস্ময়াভিভূত হল। সে অবাক হয়ে বলল, একি! আপনি বাচ্চাদের চুমু দেন! উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললে, আল্লাহ তাআলা যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া মায়া ছিনিয়ে নিয়ে থাকেন তবে আমি তোমাকে কোন সহায়তা করতে পারি না। (বুখারি, মুসলিম)
عن أبو هُرَيْرَةَ رَضِي اللَّهم عَنْهم قَالَ: قَبَّلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْحَسَنَ بْنَ عَلِيٍّ وَعِنْدَهُ الأقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ التَّمِيمِيُّ جَالِسًا فَقَالَ: الأَقْرَعُ إِنَّ لِي عَشَرَةً مِنَ الْوَلَدِ مَا قَبَّلْتُ مِنْهُمْ أَحَدًا فَنَظَرَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ قَالَ: مَنْ لا يَرْحَمُ لا يُرْحَمُ (البخاري ومسلم)
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাতি হাসান (রা.)কে আকরা ইবনে হুবাইস (রা.)-এর উপস্থিতিতে চুমু দেন। আকরা বললেন, আমার দশটি ছেলেমেয়ে আছে। অথচ আমি তাদের কখনো চুমু দেই নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যদের প্রতি দয়া দেখায় না, সে আল্লাহ তাআলার দয়া থেকেও বঞ্চিত হয়। (বুখারি, মুসলিম)

প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের সাথে সমতাসুলভ আচরণ:
————————————————–
সেই প্রাচীন যুগে যখন কন্যা সন্তানকে উপেক্ষা করা হতো, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলে ও মেয়ে সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য না দেখানোর ও সন্তানদের সমান চোখে দেখার তাগিদ- নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
اتقوا الله، واعدلوا بين أولادكم
‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রেখ।’ (বুখারি ও মুসলিম )

ছেলেমেয়ের প্রতি অসমতার কিংবা অন্যায্য আচরণ করা ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ।
عن النعمان بن بشير أنه قال إن أباه أتى به رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال إني نحلت ابني هذا غلاما كان لي فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم أكل ولدك نحلته مثل هذا فقال لا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فارجعه وفي رواية قال : فلا تشهدني إذا ، فإني لا أشهد على جور ) وفي رواية ( لا تشهدني على جور (البخاري ومسلم )
নুমান ইবনে বশীর (রা.) বর্ণনা করেন, একদা তার পিতা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে যান এবং তাকে জানান যে, তিনি আমাকে একটি ক্রীতদাস দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি তার সকল ছেলেমেয়েকে একটি করে ক্রীতদাস দিয়েছেন কিনা। আমার পিতা উত্তর দিলেন, তিনি তেমনটি করেন নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আল্লাহর প্রতি তোমার কর্তব্যকে স্মরণ রেখ এবং তোমার সকল ছেলেমেয়ের ব্যাপারে তাকে ভয় কর। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি একটি অন্যায় কাজে সাক্ষ হতে চাই না।’ (বুখারি, মুসলিম) একথা শুনার পর নুমানের পিতা ক্রীতদাসটি ফিরিয়ে নেন।

হাঁ তবে বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা বৈধ। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি কোন ছেলে স্থায়ীভাবে অসুস্থ, বিকলাঙ্গ কিংবা অর্থনৈতিক সমস্যায় থাকে তখন পিতামাতা অন্যান্য ছেলেমেয়ের চেয়ে তাকে অধিক দয়া ও অনুগ্রহ করতে পারে।
পুত্রসন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর অগ্রাধিকার না দেয়া:

আমারা জানি, প্রাক ইসলামি যুগে আরবরা তাদের কন্যা সন্তানকে এতই অপছন্দ করত যে, যদি কেউ কোন কন্যাসন্তানের পিতা হত, তবে সে তাকেঅ বহেলা করত, কন্যা সন্তানদের জন্মদানকে অনেক ক্ষেত্রে অবমাননার চোখে দেখা হতো,কখনওবা জীবন্ত কবর দিয়ে দিত। ইসলামী দৃষ্টিতে শুধু সন্তান হত্যাই নয়, ভ্রূণ হত্যাকেও মহাপাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

কোরান মাজিদে এরশাদ হয়েছে:
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ ﴿٨﴾ بِأَيِّ ذَنبٍ قُتِلَتْ ﴿٩﴾ [التكوير:8-9 (
যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে,কি অপরাধে তাকে হত্য করা হল? (তাকভীর:8-9)

অসভ্য ও বর্বর আরব জাতি, যারা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করত তাদের উদ্দেশে মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ এ জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী বাণী নাযিল করলেন, সূরা বনি ইসরাইলের ৩১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে_ ‘
وَلا تَقتُلوا أَولادَكُم خَشيَةَ إِملاقٍ نَحنُ نَرزُقُهُم وَإِيّاكُم إِنَّ قَتلَهُم كانَ خِطئًا كَبيرًا ﴿بني اسرائيل: ٣١﴾
“তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা দারিদ্র-ভয়ে হত্যা করো না, তাদেরকে ও তোমাদেরকে আমিই রিযিক দিয়ে থাকি; তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।” (বাণী ইসরাইল-৩১)।

পবিত্র কুরআন আল্লাহ বলেন,
قَد خَسِرَ الَّذينَ قَتَلوا أَولادَهُم سَفَهًا بِغَيرِ عِلمٍ وَحَرَّموا ما رَزَقَهُمُ اللَّـهُ افتِراءً عَلَى اللَّـهِ قَد ضَلّوا وَما كانوا مُهتَدينَ ﴿الأنعام١٤٠﴾
‘’নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা নিজ সন্তানদের নির্বুদ্ধিতাবশত কোনো প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদের যেসব নেয়ামত দিয়েছিলেন সেগুলোকে আল্লাহর ওপর ভ্রান্ত ধারণাবশত নিজেদের ওপর হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চয়ই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি।’'(সূরা আনআমের ১৪০ নম্বর আয়াত)

প্রাক-ইসলামী অন্ধকার যুগের হীন মনোবৃত্তির কথা মহান আল্লাহ মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পবিত্র কোরান মাজিদে এরশাদ হয়েছে:
وَإِذا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِالأُنثى ظَلَّ وَجهُهُ مُسوَدًّا وَهُوَ كَظيمٌ ﴿٥٨﴾ يَتَوارى مِنَ القَومِ مِن سوءِ ما بُشِّرَ بِهِ أَيُمسِكُهُ عَلى هونٍ أَم يَدُسُّهُ فِي التُّرابِ أَلا ساءَ ما يَحكُمونَ ﴿٥٩﴾[النحل: 58-59]
যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তারা মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে।তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট। (সূরা নাহল:58-59)

বর্তমান সমাজে অনেকেই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে খুবই বিব্রতবোধ করেন। একাধিক কন্যা হলে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে বিভিন্ন রকম অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে। এমনকি তালাক দেওয়ার মতো নির্মম ও অত্যন্ত জঘন্য পথেও পা বাড়ায়। নানাভাবে তাকে নিগৃহীত করা হয়। অথচ ছেলে-মেয়ে দান করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তালা। তিনি এরশাদ করেন:
لِّلَّـهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ ﴿٤٩﴾ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَن يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ﴿٥٠﴾ سورة الشورى الآية 49,50
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। (শূরা: 49-50)

ইসলাম কেবল এই প্রথার মুলোৎপাটনই করে নাই; বরং কন্যাসন্তানকে পুত্র সন্তানের সমান মর্যাদা প্রদান করেছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ” من كانت له بنت ، فأدبها فأحسن تأديبها ، وعلمها فأحسن تعليمها ، وأسبغ عليها من نعم الله التي أسبغ عليه ، كانت له سترا وحجابا من النار ”
যে ব্যক্তি কোন কন্যা সন্তানের পিতা হবে সে যেন তাকে আঘাত না দেয়, তার সাথে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার না দেয়। আল্লাহ তাআলা তাকে কন্যা সন্তানের সাথে সদয় আচরণ করার কারণে পরবর্তীতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আহমদ, হাকেম)
من كان له ثلاث بنات يؤويهن ويكفيهن ويرحمهن فقد وجبت له الجنة البتة.
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) আরও বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ তার একটি কন্যা সন্তানের সাথে সদয় আচরণ করে এবং তাকে জীবন্ত কবরস্ত না করে, আর পুত্র সন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার না দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আবু দাউদ)

“আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন“ সুসংবাদ থেকে বুঝা যায়, কন্যা সন্তানের সাথে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা আল্লাহর তাআলার সন্তুষ্টি, দয়া ও পুরষ্কার লাভের একটি উপায়।

عن عائشة ـ رضي الله عنها ـ قالت: دخلت امرأة معها ابنتان لها تسأل فلم تجد عندي شيئا غير تمرة، فأعطيتها إياها فقسمتها بين ابنتيها ولم تأكل منها، ثم قامت فخرجت، فدخل النبي صلى الله عليه وسلم علينا فأخبرته، فقال: من ابتلي من هذه البنات بشيء كن له سترا من النار). رواه البخاري ومسلم.(
আয়েশা (রা.) বলেন, একদা এক নারী তার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে খাবার ভিক্ষা চাইতে আসে। আমি বাড়িতে কেবল একটি মাত্র খেজুর খুঁজে পাই, যা আমি তাকে দান করি। সে এটিকে দুভাগে ভাগ করে দুই মেয়েকে খাওয়ায় এবং নিজে তা থেকে কিছুই খায় না। অতঃপর সে আমার ঘর ছেড়ে চলে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলে আমি তাঁকে এ নারী সম্পর্কে বলি। তিনি বললেন, যার কন্যা সন্তান রয়েছে এবং সে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করে সে কিয়ামতের দিন তাদেরকে দেখতে পাবে যে, তারা তার জন্যে জাহান্নাম থেকে ঢালের কাজ দিচ্ছে। (বুখারি, মুসলিম)

وعن أنس بن مالك قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من عال جاريتين حتى تبلغا جاء يوم القيامة أنا وهو ـ وضم أصابعه ـ )رواه مسلم.(
আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত দুটি কন্যা সন্তানকে মমতার সাথে লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন সে ও আমি এমন থাকব। আনাস (রা.) বলেন, যখন তিনি একথা বলছিলেন, তিনি তাঁর দুই আঙ্গুল তোলেন এবং দুটিকে কাছাকাছি রাখেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)

فعن عقبة بن عامر قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: من كان له ثلاث بنات، فصبر عليهن وأطعمهن وسقاهن وكساهن من جدته، كن له حجابا من النار يوم القيامة. رواه ابن ماجه وأحمد،من عال ثلاث بنات أو ثلاث أخواتٍ وجبت له الجنة
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি তিনটি কন্যা সন্তান কিংবা বোনের দেখাশুনার দায়িত্ব নিবে, তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে, তাদের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান হল জান্নাত। (আবু দাউদ, তিরমিযি)

একটি বিধবা কন্যার দেখাশুনার দায়িত্ব নেওয়া:
————————————————
পশ্চিমা সমাজে পিতামাতা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব অনুভব করে না। পক্ষান্তরে, ইসলাম এটিকে পিতামাতার একটি মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে। ইসলাম প্রাপ্ত বয়স্কা কন্যা সন্তানের দেখাশুনার জন্যে বিশেষ পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে এবং এই কাজের জন্য ব্যয় করাকে সর্বোত্তম দান হিসেবে অভিহিত করেছে। এভাবে ইসলাম কন্যা সন্তানকে কেবল একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানই দান করে নি, বরং তাদের মৌলিক অধিকার ও প্রয়োজনমূহেরও নিরাপত্তা বিধান করে। সুরাইকা ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وعن سراقة بن مالك أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ” ألا أدلكم على أفضل الصدقة ؟ ابنتك مردودة إليك ليس لها كاسب غيرك ” . رواه ابن ماجه
আমি কি তোমাকে সর্বোৎকৃষ্ট দান সম্পর্কে বলব না? তা হল তোমার সেই কন্যা সন্তানকে সহযোগিতা করা, যে তোমার কাছে ফিরে এসেছে এবং তুমি ব্যতিত যার কোন সহায়তাকারী নেই। (ইবনে মাজাহ)

স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা বিধবা মাতাদের জন্য সুসংবাদ:
——————————————————–
স্বামীগতা রমনী হল সে, যে স্বামী থেকে বঞ্চিত; অথচ সে রূপ-যৌবন ও সমাজে সম্মানের অধিকারী। কিন্তু নিজেকে (পুনরায় বিয়ে না করে) ধরে রেখেছে ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার জন্য; যতদিন না তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় কিংবা মৃত্যুবরণ করে।

যদিও ইসলাম তালাক প্রাপ্তা কিংবা স্বামীগতা বিধবা নারীদেরকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে উৎসাহিত করে, তা বিয়ের বিবেচনা সেই স্ত্রীলোকের উপর ছেড়ে দেয়। যদি কোন নারী ছেলেমেয়ের ভালবাসা ও দেখাশুনার জন্য বিয়ে না করাকে পছন্দ করে তার পুরষ্কার হল কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুসঙ্গ লাভ করা।

হজরত আওফ ইবনে মালেক আশযাঈ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عن عوف بن مالك الأشجعي قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أَنَا وَامْرَأَةٌ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ كَهَاتَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – وَجَمَعَ بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى – امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ آمَتْ مِنْ زَوْجِهَا ، حَبَسَتْ نَفْسَهَا عَلَى أَيْتَامِهَا حَتَّى بَانُوا أَوْ مَاتُوا ) . رواه البخاري في ” الأدب المفرد ” (رقم/141) وأحمد في ” المسند ” (39/432)، وأبو داود في ” السنن ” (5149)، وابن أبي الدنيا في ” النفقة على العيال ” (1/232)، والطبراني في ” المعجم الكبير ” (18/56)
আমি ও একজন স্বামীগতা রমনী কিয়ামতের দিন এই দুই আঙ্গুলের মত (কাছাকাছি) থাকব। বর্ণনাকারী বলেন, একথা বলার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মধ্যমা ও তর্জনী উঁচু করে দেখান। (আবু দাউদ)

ছেলে মেয়েদের জন্য খরচ করা:
عن أبي مسعود الأنصاري فقلت عن النبي فقالعن النبي صلى الله عليه وسلم قال إذا أنفق المسلم نفقة على أهله وهو يحتسبها كانت له صدقة (صحيح البخاري » كتاب النفقات » باب فضل النفقة على الأهل)
হজরত আবু মাসঊদ বদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের জন্য ব্যয় করে, তা তার আমল নামায় দান হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। (বুখারি, মুসলিম)
وعن أم سلمة رضي الله عنها قالت : قلت : يا رسول الله ، هل لي أجر في بني أبي سلمة أن أتفق عليهم ، ولست بتاركتهم هكذا وهكذا إنما هم بنيّ ؟ فقال:(( نعم لك أجر ما أنفقت عليهم )) متفق عليه(رواه البخاري ، كتاب النفقات ، باب وعلى الوارث مثل ذلك ، رقم ( 5369 ) ، ومسلم ، كتاب الزكاة ، باب فضل النفقة والصدقة على الأقربين ،رقم (1001(.
হজরত উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি যদি আমার প্রথম পক্ষের ছেলে মেয়েদের উপর খরচ করি, তবে কি কোন সওয়াব লাভ করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর করলেন, তুমি তাদের উপর খরচ কর। তুমি যা-ই তাদের উপর খরচ করবে তার সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করবে। (বুখারি, মুসলিম)
وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم (( دينار أنفقته في سبيل الله ، ودينار أنفقته في رقبة ، ودينار تصدقت به على مسكين ، ودينار أنفقته على أهلك ، أعظمها أجر الذي أنفقته على أهلك )) رواه مسلم ، كتاب الزكاة ، باب فضل النفقة على العيال ، رقم ( 995 ) قال رسول الله صلى الله عليه وسلم (( أفضل دينار ينفقه الرجل دينار ينفقه على عياله ، ودينار ينفقه على دابته في سبيل الله ، ودينار ينفقه على أصحابه في سبيل الله )) رواه مسلم ، كتاب الزكاة ، باب فضل النفقة على العيال . . . ، رقم ( 994 .) .
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের টাকা পয়সা (দীনার) আল্লাহর রাস্তায় দান কর। যে টাকা তোমরা ক্রীতদাস মুক্ত করার জন্য ব্যয় কর, যে দীনার তোমরা গরীবদেরকে দান কর এবং যে দীনার তোমরা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য ব্যয় কর- তন্মধ্যে পূণ্যের বিচারে সর্বোত্তম হল যা তোমরা পরিবার ও সন্তানদের জন্য ব্যয় কর। (মুসলিম)
وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( كفى بالمرء إثماً أن يضيع من يقوت )) رواه أبو داود ، كتاب الزكاة ، باب فضل في صلة الرحم ، رقم ( 1692 ) .
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি তার অধীনস্তদের, যাদের জীবন -যাপন তার নিয়ন্ত্রণাধীন তাদের, উপযুক্ত অধিকার প্রদান থেকে বিরত থাকা একটি বড় পাপ। (আবু দাউদ)

আদর – সোহাগ পাওয়া শিশুর অধিকার:
শিশুদের আদর-সোহাগ করা সুন্নাত। রাসূল সা. বাচ্চাদের আদর-সোহাগ করতেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
عبدالله بن عمرو يقول : قال ثنا رسول الله -صلى الله عليه وسلم- :” ليس منا من لم يرحم صغيرنا، ويعرف حق كبيرنا ” .( رواه أبو داود، والترمذي، وقال: حسن صحيح. أخرجه الحاكم في المستدرك على الصحيحين (1/62) من طريق الحميدي به ، وقال :” هذا حديث صحيح على شرط مسلم ،)
“যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া-স্নেহ করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান করেনা সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়’।” (তিরমিযী,হাকেম)

অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদন শিশুর অধিকার:
——————————————————-
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গঠন করেছিলেন। তিনি শিশুদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যে কোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। তাই শিশুদের শারীরিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عن ابن عباس : أكرموا أولادكم واحسنوا أدبهم (رواه ابن ماجة)
‘তোমরা শিশুদের স্নেহ কর, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)

শিশুর শারীরিক মানসিক সব ধরনের পরিচর্যা করা পিতা মাতার দায়ীত্ব।
—————————————————————————–
সন্তানের শারীরিক পরিচর্যা বলতে বোঝায় তার খাবার দেয়া, তার দেহের যত্ন নেয়া, তার শরীরের কোন অসুবিধা থাকলে তা দূর করা ইত্যাদি।

আকীকার বিধান এজন্যই দেয়া হয়েছে। আকীকার দ্বারা সন্তানের শারীরিক আপদ বালা দূর হয়ে থাকে। তাই আকীকা করাকে সুন্নত করা হয়েছে। যতভাবে সন্তানের বিপদ আপদ আসতে পারে, এই সব কিছুকে সাধ্যমত ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়া পিতা-মাতার দায়িত্ব।

শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী দিয়েছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান কর, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (মুসলিম)।

একবার তিনি শিশু হযরত হুসাইন (র) কে সমজিদের ভেতরে নিজ পিঠের উপর রেখে নামাজ আদায় করেছিলেন। এর চেয়ে আদর-সোহাগের বহিঃপ্রকাশ আর কি হতে পারে?
فعن عبد الله بن شداد عن أبيه قال: خرج علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم في إحدى صلاتي العشاء، وهو حامل حسناً أو حسيناً، فتقدم رسول الله صلى الله عليه وسلم فوضعه ثم كبر للصلاة، فسجد بين ظهراني صلاته سجدة أطالها، فرفع شداد رأسه، فإذا الصبي على ظهر رسول الله صلى الله عليه وسلم، فلما قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم الصلاة قال الناس: يا رسول الله! إنك سجدت بين ظهراني صلاتك سجدة أطلتها، حتى ظننا أنه قد حدث أمر، أو أنه يُوحى إليك. قال: “كل ذلك لم يكن، ابني ارتجلني، فكرهت أن حتى يقضي حاجته” (رواه النسائي(

সাঁতার শিক্ষা দেওয়া, তীর নিক্ষেপ শিক্ষা দেওয়া : ইসলামী শরিয়াতে সন্তানাদিকে সাঁতার শিক্ষা দেওয়া, তীর নিক্ষেপ শিক্ষা দেওয়া ও পিতা-মাতার দায়ীত্ব। শিশু অধিকার সংরক্ষণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিস তাৎপর্যের দাবিদার। তিনি বলেছেন,
عن أبي رافع قال قلت : يا رسول الله أللولد علينا حقٌ كحقنا عليهم ؟ قال : نعم ؛ حق الولد على الوالد أن يعلمه الكتابة والسباحة والرمي.. ) البيهقي رواه الديلمي في مسنده ( كما في الكنز 45341 و 45343 )
‘পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়া, সাঁতার শিক্ষা দেওয়া, তীর নিক্ষেপ শিক্ষা দেওয়া এবং ভালো ও পবিত্র খাদ্য খাওয়ানো।’ (বায়হাকি)

উপরোক্ত হাদিসে শিশুর পড়াশোনা করানোকে তার অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সামর্থ্য গড়ে তোলার জন্য সাঁতার ও তীর নিক্ষেপ শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হালাল ও উত্তম খাবার খাওয়ার সুযোগকে শিশু অধিকারের অন্তর্গত করা হয়েছে।

সন্তানকে পেশা শিক্ষা দেয়া:
—————————–
পিতা-মাতার অবর্তমানে বা শিশু বালেগ হয়ে যাওয়ার পর সে যেন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এরকম যে কোন একটা পেশা সন্তানকে শিখিয়ে দেয়া দায়িত্ব। যাতে সে অনাহারে কষ্ট না পায়, বিপদগ্রস্থ না হয়। যেমন চাষাবাদ, নৌকা চালানো, গাড়ি চালানো, (সার্মথ্য আনুযায়ী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু বানানো) ইত্যাদি যার উপর নির্ভর করে সে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এরকম যে কোন একটা শিখিয়ে দেয়া পিতা-মাতার দায়িত্ব। শিশু কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন,
إِنَّكَ إِنْ تَتْرُكْ وَرَثَتْكَ أَغْنِيَاءَ ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَتْرُكَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ ، وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً إِلا أُجِرْتَ عَلَيْهَا ، حَتَّى اللُّقْمَةَ تَرْفَعُهَا إِلَى فِيِّ امْرَأَتِكَ ” .
‘তোমার বংশধরদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভাল।’ (বুখারি, মুসলিম)

ছেলে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা:
—————————————————-
পিতামাতার বিশেষত: পিতার দায়িত্ব যে, তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করবে যখন তারা প্রাপ্ত বয়সে উপণীত হয়। যদি তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং ছেলেমেয়েরা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে পিতাও তাদের পাপের জন্য দায়ী সাব্যস্ত হবে।
من عال جاريتين حتى تبلغا ورباهن فأحسن تربيتهن وزوجهن كن له سترا من النار
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সন্তান সন্ততি লাভ করেছে সে যেন তাদেরকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেয় এবং যখন তারা প্রাপ্ত বয়সে উপণীত হয়, তাদের যেন বিয়ের ব্যবস্থা করে। যদি পিতামাতা তা করতে অবহেলা করে কিংবা তা বিলম্বিত করে এবং ছেলে মেয়েরা নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তবে তাদের অপরাধ ও পাপের জন্য পিতাকে দায়ী করা হবে। (বায়হাকি)

উপসংহার:
————
শিশুরা মা-বাবার হূদয়ের ফুল এবং মানব উদ্যানের হূদয়কাড়া সৌন্দর্য। তাই অন্তরের সত্যিকার মায়া-মমতা দিয়ে শিশুদের লালন-পালন করা এবং তাদের আদর্শ জীবন গঠন করা সবার কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুপম শিক্ষা ও নীতিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া শিশুদের প্রকৃত আদর্শ জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

শিশু আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত উত্তম নিয়ামত। এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশপূর্বক তাদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া প্রতিটি শিশুর মা-বাবার পবিত্র দায়িত্ব। আজকের শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি বা শিশুরা পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থ্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং বাঞ্ছিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট।’ (সূরা আল-কাহ্ফ, আয়াত: ৪৬)

আধুনিক যুগে পরিবারই শিশুর মূল শিক্ষাকেন্দ্র হওয়া উচিত। মা-বাবাই শিশুর জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, আর ঘর হলো শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। শিশুদের মনের মতো করে গড়ে তোলা খুবই কঠিন। শান্ত হলেও শিশু শিশুই। তারা অনুভূতিপ্রবণ ও অনুকরণপ্রিয়। শিশুর সামনে যা কিছুই বলা হবে বা করা হবে, এর একটা চিত্র তার মনে অঙ্কিত হয়ে যায়; যা ভবিষ্যতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

তাই যে সংসারে মা-বাবা নিজেদের মধ্যে ভালো ব্যবহার করে, ভদ্রভাবে চলে, সুন্দর কথা বলে, সে সংসারের শিশুরাও ভালো হয়। যে সমাজসংসারে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ, পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, সেসব সংসারের শিশুরা হয় অবাধ্য ও দুর্বিনীত। তারা বড় হয়ে মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখায়। এ জন্য মা-বাবাকে শিশুদের সামনে সংযত হয়ে চলা বা কথা বলা উচিত; যাতে পরিবারে শিশুরা সুশিক্ষা পায়।

No comments

Powered by Blogger.