ইসলামে মানবাধিকার

জুমার খুতবা
*********************************
৪র্থ জুমা’ যুল হাজ্জাহ ১৪৩৮হি: সেপ্টেম্বর- ২০১৭

ইসলামে মানবাধিকার
==============
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم
অশান্ত পৃথিবীর বিক্ষুব্ধ জনতার আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে উন্মুক্ত গগনের মুক্ত পবন আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বে কোটি কোটি অভুক্ত বনু আদমের অমানবিক জীবন প্রবাহের নিদারুণ চিত্র সচেতন মানুষকে ব্যথিত করছে।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রসঙ্গটি নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। মানবাধিকারের মানদ-, সমাজভেদে তার প্রয়োগগত সংজ্ঞা, সীমা ও ব্যাখ্যা সম্পর্কেও তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। মানবাধিকার রক্ষা বা প্রতিষ্ঠায় উন্নত দেশসমূহের গৃহীত পদক্ষেপ উন্নয়নশীল সমাজে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মূল্য মর্যাদার ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক নাকি অধিকার হরনের নতুন পন্থা সে সম্পর্কেও উন্নত, উন্নয়নশীল সব সমাজেই চলছে ব্যাপক আলোচনা।

ক্ষেত্রবিশেষে ভক্ষকরাই এর রক্ষক হওয়ার এবং পথভ্রষ্টরা পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অভিনয় করছে। মানবাধিকার আইনের ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও বিশ্বে মানবাধিকার এখনও তার সঠিক স্থান লাভ করতে পারেনি।

প্রাসঙ্গিকভাবেই জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার বিষয়টি সেসব আলোচনা, সমালোচনায় চলে আসছে। কিন্তু অনেকের হয়ত ধারণা নেই, মানবিক মূল্য-মর্যাদা তথা মানবাধিকারের ব্যাপক বিস্তৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ও প্রায়োগিক উদাহরণের মাধ্যমে একটি অনুসরণযোগ্য সার্বজনীন আদর্শ সেই সপ্তম শতাব্দীর শুরুতেই একজন মহাপুরুষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অত্যন্ত সফলভাবে।

তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আজকের প্রেক্ষাপটে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেসব মানবতাবাদী নীতি-দর্শন নতুন করে অধ্যয়ন ও পর্যালোচনার দাবী রাখে। কারণ তাতে হয়ত দেখা যাবে সমকালীন বিশ্বে মানুষের সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সেসব নীতি-দর্শনের প্রয়োগ কেবল গ্রহণযোগ্য বা প্রয়োগ উপযোগীই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে একান্ত আবশ্যকীয়।

মানবাধিকার ধারণা এবং তার বিকাশ:
—————————————–
মানবাধিকার শব্দটি দু’টো আলাদা শব্দ দিয়ে গঠিত- মানব ও অধিকার। দু’টো শব্দের অর্থগত ব্যাপকতা রয়েছে। তবে সংক্ষেপে বলা যায়, মানবাধিকার হলো মানুষের প্রতি স্বীকৃতি। শুধু খাদ্য-বস্ত্রের মতো মৌলিক অধিকারই নয়, এতে অন্তর্ভুক্ত মানুষে-মানুষে সাম্য ও বাক স্বাধীনতার মতো আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারও।

মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ধন-সম্পদ, জেন্ডার নির্বিশেষে সমভাবে দেখে তার সহজাত ও স্রষ্টা প্রদত্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাই হচ্ছে ‘মানব মর্যাদা’। মানুষের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষা, সহজাত ক্ষমতা ও প্রতিভার সৃজনশীল বিকাশ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কতিপয় অধিকার স্বত্বই হচ্ছে ‘মানব মর্যাদা’। মানুষের এই অধিকার তার জন্মগত এবং মানবিক মূল ও মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকারের ধারণাটি আল্লাহ্ প্রদত্ত। পশ্চিমা ও সমসাময়িক মানবাধিকার ধারণার মত ইসলামে মানবাধিকার কোন মানব-চিন্তাপ্রসূত কনসেপ্ট নয়। যুগে যুগে মানবতার মুক্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আশাবাদ শুনিয়েছেন বিভিন্ন মহামানব। ইসলামের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সপ্তম শতকে হাজির হয়েছিলেন মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে।

তিনি প্রচার করেছেন মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি ও মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে।(তীন, আয়াত-০৪) ইসলাম বর্ণ, গোত্র, ভাষা, সম্পত্তি বা অন্য কোনো মর্যাদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে না। এটি একটি সম্বন্বিত ধারণা।
ইসলামে ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে রয়েছে জীবনের নিরাপত্তা, নারীর অধিকার, হত্যা না করা, গীবত না করা, ক্ষমা প্রদর্শন, সদাচরণ, রাজনৈতিক অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, ব্যক্তিগত অধিকারসহ অনেক কিছু। সামাজিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মালিকানার অধিকার, সাম্যের অধিকার, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার, লেখা, বলা ও প্রচার কার্যের অধিকার।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-‘আমি মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও চমৎকার অবয়বে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা-আত তিন : ০৪)
আরও বলা হয়েছে- ‘তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, মানবের কল্যাণের জন্য।’ (সূরা-আল-ইমরান : ১১০) মানুষে মানুষে সাম্যের ধারণাটি পাওয়া যায় অন্য আয়াতে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক নর ও নারী হতে।’ (সূরা-আল হুজরাত : ১৩)

মানুষের বেঁচে থাকার ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার:
—————————————————-
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের জীবনে অধিকার ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন ”সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানানো এবং মানুষকে হত্যা করা।”(বুখারী-৫৬৩২)

বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে (যাকে মানবাধিকারের আদি সনদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়) প্রিয় নবী হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই তোমাদের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত (অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে) পবিত্র।”(বোখারী শরীফ, হাদীস নং- ১২৫১-১২৫৩।)

বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন- “হে মুসলিমগণ! আমার পরে তোমরা কাফেরদের কার্যকলাপে লিপ্ত হইও না যে তোমরা একে অপরকে হত্যা করিতে আরম্ভ কর।” তিনি বলেন, কোনো আরবের উপরে অনারবের প্রাধান্য নেই। প্রাধান্য নেই কোনো অনারবের আরবের ওপর। সাদা মানুষের প্রাধান্য নেই কালো মানুষের উপর।(বোখারী শরীফ হাদীস নং- ১২৫১-১২৫৩।)

মানুষের সম্মান কোনো বর্ণ-গ্রোত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বরং খোদাভীরুতা বা তাকওয়া নির্ধারণ করবে ব্যক্তির মর্যাদা। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান হলো যারা তাকে ভয় করে।’ (সূরা- আল হুজরাত : ১৩)


সমাজে মর্যাদার সাথে বাস এবং জানমালের হেফাজতের হচ্ছে একজন মানুষের সামাজিক অধিকার। ইসলাম কাউকে কারো মর্যাদা হরণ ও অন্যায়ভাবে হত্যার অনুমোদন দেয় না। আল্লাহ বলেন : ‘অন্যায়ভাবে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল।’(আল মায়েদা-৩২)

এমনকি যুদ্ধের সময় বিরোধী পক্ষের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে।

স্বাধীনভাবে চলাচল, বসবাস, রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব লাভের অধিকার:
———————————————————————————–
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের যে কোন স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের অধিকার প্রদান করে। তিনি বলেন, “সমগ্র দেশ আল্লাহর আর মানুষ আল্লাহর বান্দা, তুমি যেখানে মঙ্গলজনক মনে কর বসবাস কর।”

নিপীড়ন-নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের অধিকার:শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেয়াকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন, “প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি যা কথা বা হাত (কাজের নিপীড়ন) থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায়:
—————————–
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক স্পষ্ট ভাষায় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন যে, “আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।”(আল আন্বিয়া-১০৭)

কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য সাধারণ উদাহরণ রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় এবং সর্বজন স্বীকৃত অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত।

কেননা তিনি কেবল মুসলিমদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানব জাতির আদর্শ। আল্লাহ পাক তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন: “বলুন (হে প্রিয় নবী), হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রসূল।”(আল আ’রাফ-১৫৮)

অন্য ধর্মের মানুষের অধিকার:
——————————–
ইসলামের শান্তির বাণী শুধু নিজ ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পরমত ও পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যে গুরুত্ব দেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হিজরি ৬২৪ সালের ‘মদীনা সনদ’ মানবাধিকারের স্বীকৃতির জন্য বিখ্যাত। এই সনদে ৪৭টি ধারা ছিল।

ধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. মদীনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি জাতি গঠন করবে।
২. পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৩. রক্তপাত, হত্যা, ব্যভিচার এবং অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।
৪. দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।

এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় তিনি বলেছেন: “মনে রেখো! যদি কোন মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার উপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিযিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব।”(মিশকাত-৪০৪৭)

প্রিয় নবী আরো বলেছেন: “কোন মু‘আহীদকে (মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে) হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।” (বুখারী-৬৫৬১)

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকারের ধারণা:
——————————————–
ইসলামে মানবাধিকারের মূল উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ্। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং যোগ্যতা ও সুযোগের অসমতার কারণে মানুষের মধ্যে কেউ শাসিত, কেউ ধনী, কেউ গরীব হতে পারে কিন্তু মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়া এবং সকল ব্যাপারে সুবিচার লাভ করা তার অলংঘনীয় অধিকার। ইসলামী আইনে মানবাধিকার স¤পর্কিত আইনসমূহ রাষ্ট্র ও নাগরিক অধিকার আইন, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক আইন, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনসহ সকল আইনই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ইসলামে মানবাধিকারের শ্রেণীবিন্যাস:
—————————————–
ইসলামের বিধান মতে মানবজাতির উপর যে দায়িত্বগুলো অর্পিত হয়েছে সেগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: স্রষ্টার অধিকার বা হাক্কুল্লাহ এবং মানুষের অধিকার বা হাক্কুল ইবাদ। উভয় প্রকার অধিকার তথা স্রষ্টার অধিকার ও তাঁর সৃষ্টির অধিকার আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত হয়েছে এবং এ দুই ধরনের অধিকারের জন্য মানুষকে আল্লাহ্র নিকট জবাবদিহি করতে হবে। আবার হাক্কুল ইবাদ-এর অন্তর্ভুক্ত মানবাধিকার দুই ধরনের হতে পারে। প্রথম শ্রেণীতে সেসব অধিকার অন্তর্ভুক্ত যেগুলো পালনে ইসলামী রাষ্ট্র সরাসরি বাধ্য করবে এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে সেসব অধিকার অন্তর্ভুক্ত যেগুলো পালনে রাষ্ট্র সরাসরি বাধ্য করবে না। প্রথম শ্রেণীর অধিকারসমূহকে আইনগত অধিকার এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর অধিকারকে নৈতিক অধিকার রূপে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

মানবাধিকার ধারণা স¤পর্কে পশ্চিমাদের দাবি:
———————————————
পশ্চিমারা এটা দাবী করে যে, মানবাধিকারের ধারণাটি বিশ্ববাসীর নিকট তারাই প্রথম উপস্থাপন করেছে। বস্তুত: পশ্চিমাদের এটা একটি সহজাত প্রবৃত্তি যে, পৃথিবীতে সকল প্রকার উন্নয়নের একমাত্র দাবী তারাই করবে। অথচ আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলাম মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যাবলী ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘ বহু পরে ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার নীতি ঘোষণা করে যা ৬১০ সালেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, নির্বিশেষে সবার জন্য সমান প্রযোজ্য বলে ঘোষিত হয়েছিল। বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি জাতিসংঘ তার একটি সম্মেলনে যুদ্ধবন্দীদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে যা প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে ৬২৪ সালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদের প্রদান করে গেছেন।

পশ্চিমারা যেখানে মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়নে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সেখানে ইসলামে মানবাধিকার আল কুরআন দ্বারা স্বতঃসিদ্ধ বা সুনিশ্চিত। এর প্রয়োগ জাতি ও ব্যক্তি উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ জন্যে আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্বের একশত জন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে দি হান্ড্রেডস (ঞযব ঐঁহফৎবফং) শিরোনামে যে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাতে তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর মানবতাবাদের জন্য বিশেষ করে বিদায় হজ্বের ভাষণে যে মানবাধিকারের ঘোষণা করেছেন তার জন্য সবার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে আরব-অনারব, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, মনিব-ভৃত্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ ছিল না; একটিই পরিচয় ‘তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরী।(আবু দাউদ, হা-৫১১৬)মুসনাদে আহমদ, হা-৮৭২১)
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে একশ্রেণীর মুসলমানের কাছে ইসলাম অসহ্য হয়ে পড়েছে। ইসলামপন্থীরা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। এমনকি মহিলারাও নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ওদের অপরাধ হলো আল্লাহর ভাষায় ‘ওরা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে’ (সূরা বুরুজ)।

No comments

Powered by Blogger.