মাযারে ফুল অর্পণ, গিলাফ চড়ান ও বাতি জ্বালানোর প্রমাণাদি
মাযারে ফুল অর্পণ, গিলাফ চড়ান ও বাতি জ্বালান প্রসঙ্গে আলোচনা
এখানে তিনটি মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে-কবরে ফুল অর্পণ, চাদর চড়ান ও বাতি জ্বালান। উলামায়ে আহলে সুন্নাতের অভিমত হলো প্রত্যেক মু’মিনের কবরে সে আল্লাহর ওলী হোক বা গুনাহগার হোক ফুল অর্পণ জায়েয। এবং আওলিয়া, উলামা ও পুণ্যাত্মাদের কবরসমূহের উপর গিলাফ চড়ানও জায়েয। কিন্তু সাধারণ মুসলমানের কবরের উপর নাজায়েয, কেননা এর দ্বারা ওর কোন উপকার হবে না। আর বাতি জ্বালান সম্পর্কে অভিমত হলো যে, সাধারণ মুসলমানের কবরে বিনা প্রয়োজনে বাতি জ্বালানো না জায়েয, তবে প্রয়োজন বোধে জায়েয আছে। আর আওলিয়া কিরামের মাযারে সাহেবে মাযারের শান-মান প্রকাশার্থে বাতি জ্বালানো জায়েয। প্রয়োজনবোধে তিন ধরনের হতে পারে, যেমন রাত্রে লাশ দাফন করতে বাতির প্রয়োজন, তখন জায়েয। রাস্তার পার্শ্বে কবর রয়েছে তাই এজন্যে বাতি জ্বালিয়ে রাখা প্রয়োজন, যেন কেউ হোঁচট না খায় বা কবর জেনে ফাতিহা পাঠ করলো, তাহলে জায়েয। অথবা কোন ব্যক্তি রাত্রে কোন মুসলমানের কবরে গেল এবং সেখানে কুরআন শরীফ ইত্যাদি দেখে পড়ার ইচ্ছা পোষণ করলো, তখন বাতি জ্বালিয়ে রাখা জায়েয। এ তিন অবস্থা ব্যতীত বাতি জ্বালানো যেহেতু অপব্যয় ও ব্যয়বহুলতা মাত্র, তাই নিষেধ। আওলিয়া কিরামের মাযারের উপরোক্ত কোন প্রয়োজন না থাকলেও ওলীর সম্মানে এক বা একাধিক বাতি জ্বালানো জায়েয। বিরোধিতাকারীরা এ তিনটা বিষয়কে না জায়েয মনে করে। তাই এ আলোচনাকে দু’টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে এসবের বৈধতার প্রমাণ করা হয়েছে। এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ প্রসংগে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দেয়া হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়
আমি এর আগের বহছে আরয করেছি যে আল্লাহর ওলীগণ ও তাঁদের মাযারসমূহ আল্লাহর নির্দশন এবং আল্লাহর নিদর্শন সমূহ অর্থাৎ ধর্মের নিশান সমূহের সম্মান করার জন্য কুরআনী নির্দেশ রয়েছে-
وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ.
-‘‘কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে, এ-তো তার হৃদয়ের তাক্ওয়া সজ্ঞাত।’’ ১৮৯
{সূরা হাজ্জ, আয়াত নং-৩২।}
এ সম্মানের বেলায় কোন শর্তারোপ করা হয়নি। এক এক দেশে এক এক ধরনের রীতি প্রচলিত আছে। যেই দেশে এবং যেই সময়ে যে ধরনের বৈধ তাযীম প্রচলিত আছে, সেই মতে করা জায়েয। তাঁদের কবরসমূহে ফুল অর্পণ, চাদর চড়ান ও বাতি জ্বালানো ইত্যাদির উদ্দেশ্যে সম্মান প্রদর্শন, তাই এগুলো জায়েয। তাজা ফুলে যেহেতু এক প্রকার জীবন আছে, সেহেতু ওটা তসবীহ তাহলীল করে। যার ফলে মৃতব্যক্তি ছওয়াব পেয়ে থাকেন, অথবা তাঁর শাস্তি হ্রাস পায় এবং যিয়ারতকারীগণ এর থেকে সুঘ্রাণ লাভ করে। তাই এটা প্রত্যেক মুসলমানের কবরের উপর অর্পণ করা জায়েয। এর তাসবীহের বরকতে যে মৃতব্যক্তির আযাব-হ্রাস পায়, এর প্রমাণ মিশ্কাত শরীফের ادب الخلاء অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদের সেই হাদীছে রয়েছে, যেখানে বর্ণিত আছে একবার হুযুর ﷺ দু’কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইরশাদ ফরমান মৃতদ্বয়ের আযাব হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন প্রস্রাবের ছিটা থেকে সতর্ক থাকতো না এবং অপরজন পরনিন্দা করতো।
ثُمَّ أَخَذَ جَرِيدَةً رَطْبَةً، فَشَقَّهَا بِنِصْفَيْنِ، ثُمَّ غَرَزَ فِي كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لِمَ صَنَعْتَ هَذَا؟ فَقَالَ: لَعَلَّهُ أَنْ يُخَفَّفَ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا.
-‘‘অতঃপর তিনি (ﷺ) একটি কাঁচা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগ করে দু’কবরে গেঁড়ে দিলেন। সাহাবাগণ আরয করলেন-ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি এরকম কেন করলেন? তখন তিনি বললেন-যতক্ষণ পযর্ন্ত এ ডাল না শুকাবে, ততক্ষণ পযর্ন্ত ওদের আযাব কম হবে।’’ ১৯০
{(১)ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২/৯৫ পৃষ্ঠা, হাদিস/১৩৬১
(২)ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬, হাদিস-২০-২১।
(৩)ইমাম নাসাঈ, আস-সুনান, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১০৬, হাদিস-২০৬৯।
(৪)ইমাম বায়হাকী, আস-সুুনানুল কোবরা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১০৪, হাদিস-৫১০।
(৫)ইমাম খুজায়মা, আস-সহীহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২-৩৩, হাদিস-৫৫।
(৬)ইমাম ইবনে আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১১৫, হাদিস-১৩০৮।
(৭)ইমাম আবুুু ই’য়ালা, আল-মুসনাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪৩, হাদিস-২০৫০।}
❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসংগে ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন-
وَاسْتَحَبَّ الْعُلَمَاءُ قِرَاءَةَ الْقُرْآنِ عِنْدَ الْقَبْرِ لِهَذَا الْحَدِيثِ لِأَنَّهُ إِذَا كَانَ يُرْجَى التَّخْفِيفُ بِتَسْبِيحِ الْجَرِيدِ.
-‘‘এ হাদীছের উপর ভিত্তি করে উলামায়ে কিরাম কবরের পার্শ্বে কুরআন পাঠ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা আযাব কমানোর বেলায় ডালের তাসবীহ থেকে কুরআন তিল্ওয়াতের গুরুত্ব অনেক বেশী।’’ ১৯১
{ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, ৩/২০২}
❏ ‘আশআতুল লুমআত’ গ্রন্থে এ হাদীছের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে-
تمسك كنند جماعت به ايں حديث در اندا ختن سبزه وگل ريحان برقبور.
-‘‘একটি জামাত এ হাদীছকে কবরসমূহে কাঁচা ফুল ও সুগন্ধি দেয়ার বৈধতার দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন।’’ ১৯২
{শায়খ আব্দুুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, আশিয়াতুল লুম’আত, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২১৫, মাকতাবায়ে রশিদীয়্যাহ, পাকিস্তান।}
❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় মিরআতে বর্ণিত আছে -১৯৩
{মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭৬, হাদিস/৩৩৮}
وَمِنْ ثَمَّ أَفْتَى بَعْضُ الْأَئِمَّةِ مِنْ مُتَأَخِّرِي أَصْحَابِنَا بِأَنَّ مَا اعْتِيدَ مِنْ وَضْعِ الرَّيْحَانِ وَالْجَرِيدِ سُنَّةٌ لِهَذَا الْحَدِيثِ..... لِهَذَا الْحَدِيثِ إِذْ تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ أَوْلَى بِالتَّخْفِيفِ مِنْ تَسْبِيحِ الْجَرِيدِ، وَقَدْ ذَكَرَ الْبُخَارِيُّ أَنَّ بُرَيْدَةَ بْنَ الْحُصَيْبِ الصَّحَابِيَّ أَوْصَى أَنْ يُجْعَلَ فِي قَبْرِهِ جَرِيدَتَانِ ১৯৪
{ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২/৯৫ পৃঃ , পরিচ্ছেদ: بَابُ الجَرِيدِ عَلَى القَبْرِ}
বোঝা গেল যে, মাযারে ফুল দেয়া সুন্নাত।
❏ প্রসিদ্ধ তাহ্তাবী আলা মরাকিল ফলাহ কিতাবের ৩৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে-
وَقَدْ أَفْتَى بَعْضُ الْأَئِمَّةِ مِنْ مُتَأَخِّرِي أَصْحَابِنَا بِأَنَّ مَا اعْتِيدَ مِنْ وَضْعِ الرَّيْحَانِ وَالْجَرِيدِ سُنَّةٌ لِهَذَا الْحَدِيثِ.
-‘‘আমাদের উলামায়ে কিরাম এ হাদীছ থেকে ফত্ওয়া দিয়েছেন যে, কবরে সুগন্ধি ও ফুল অর্পণের যে রীতি আছে, তা’ সুন্নাত। ১৯৫
{ইমাম তাহতাভী, হাশীয়ায়ে তাহতাভী আলা মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা-৬২৪।}
উলেখ্য যে উপরোক্ত ইবারতসমূহে “কতেক আলিম ফত্ওয়া দিয়েছেন” এর ভাবার্থ জায়েয বলা নয়, বরং এর ভাবার্থ হচ্ছে কতেক আলিম একে সুন্নাত মনে করেছেন। কেননা জায়েয তো সবাই বলেন, কেবল সুন্নাত বলার ক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে।
❏ ফত্ওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহাত পঞ্চম খণ্ড زِيَارَةُ الْقُبُورِ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
وَضْعُ الْوُرُودِ وَالرَّيَاحِينِ عَلَى الْقُبُورِ حَسَنٌ ....كَذَا فِي الْغَرَائِبِ.
-‘‘কবরসমূহের উপর ফুল ও সুগন্ধি রাখা উত্তম। এমনটি গারায়েবে বর্ণিত আছে।’’ ১৯৬
{নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৫১।}
❏ ফত্ওয়ায়ে শামীর زِيَارَةُ الْقُبُورِ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছে-
وَيُؤْخَذُ مِنْ ذَلِكَ وَمِنْ الْحَدِيثِ نَدْبُ وَضْعِ ذَلِكَ لِلِاتِّبَاعِ وَيُقَاسُ عَلَيْهِ مَا اُعْتِيدَ فِي زَمَانِنَا مِنْ وَضْعِ أَغْصَانِ الْآسِ وَنَحْوِهِ.
-‘‘এ হাদীস ও অন্যান্য হাদীস থেকে ওই সমস্ত জিনিস কবরের উপরে রাখাটা মুস্তাহাব বোঝা যায় এবং এ সুবাদে কবরের উপর খেজুর গাছের ডাল ইত্যাদি দেওয়াটা, যা আমাদের যুগে প্রচলিত আছে, তা মুস্তাহাব বলা যাবে।’’ ১৯৭
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪৫।}
❏ একই জায়গায় শামীতে আরও উল্লেখিত আছে-
وَتَعْلِيلُهُ بِالتَّخْفِيفِ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا: أَيْ يُخَفَّفُ عَنْهُمَا بِبَرَكَةِ تَسْبِيحِهِمَا؛ إذْ هُوَ أَكْمَلُ مِنْ تَسْبِيحِ الْيَابِسِ لِمَا فِي الْأَخْضَرِ مِنْ نَوْعِ حَيَاةٍ.
-‘‘শুকনা না হওয়াটাই হচ্ছে আযাব কম হওয়ার কারণ অর্থাৎ ওইসবের তসবীহের বরকতে কবর আযাব কম হবে, কেননা কাঁচা ডালের তসবীহ শুকনা ডালের তসবীহ থেকে বেশী কার্যকর। কারণ ওটাতে এক প্রকার জীবন রয়েছে।’’ ১৯৮
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪৫।}
উপরোক্ত হাদীস, মুহাদ্দেসীন ও ফকীহগণের ইবারতসমূহ থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল-একটি হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমানের কবরে সজীব বস্তু রাখা জায়েয। হুযুর ﷺ ওই দু’কবরের উপর ডাল পুঁতে দিয়েছিলেন, যাদের আযাব হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে আযাব কম হওয়াটা কেবল হুযুর ﷺ'র দুআর কারণে নয় বরং এটা সজবি বস্তুর তসবীহের বরকতের ফল। যদি কেবল দুআয় আযাব কম হতো, তাহলে হাদীছে শুকনা হওয়ার শর্তারোপ কেন করা হলো? তাই, আজকাল আমরাও যদি ফুল ইত্যাদি অপর্ণ করি, তাতেও ইনশাআল্লাহ মৃতব্যক্তির উপকার হবে। সাধারণ মুসলমানদের কবর কাঁচা রাখার এটাও একটা অভিপ্রায় যে বর্ষাকালে এর উপর সবুজ ঘাস জন্মাবে এবং এর তসবীহের বরকতে মৃতব্যক্তির আযাব কম হবে। অতএব, প্রমাণিত হলো, প্রত্যেক মুসলমানের কবরে ফুল ইত্যাদি অর্পণ জায়েয। মৌলবী আশরাফ আলী সাহেব ‘ইসলাহুর রুসুম’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, ফুলমূল ইত্যাদি পাপীতাপীদের কবরসমূহে অর্পণ করা উচিৎ, আওলিয়া কিরামের কবরে নয়। কেননা তাঁদের মাযার সমূহে আযাব হয় না। কথা ঠিক, তবে জেনে রাখা দরকার যে, যেই আমলসমূহ পাপীদের পাপ হ্রাস করে, তা নেকবান্দাদের পদ মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়তা করে। যেমন মসজিদের দিকে যাত্রা করলে আমাদের গুনাহ মাফ হয় আর নেকবান্দাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ওনার যুক্তি থেকে এটাই প্রকাশ পায় যে, নেকবান্দাগণ যেন মসজিদে না আসেন এবং মাগফিরাতও কামনা না করেন, কেননা তাঁরা গুনাহ থেকে পবিত্র। জনাব, ওইসব ফুলের তসবীহের বররতে তাঁদের কবরে খোদার রহম আরও বৃদ্ধি পায়, যেমনি কুরআন তিলাওয়াতের ফলে হয়ে থাকে।
(২) আওলিয়া কিরামের কবরের উপর চাদর বা গিলাফ চড়ান জায়েয, কেননা এ ফলে যিয়ারতকারীদের কাছে ছাহেব কবরের মর্যাদা প্রকাশ পায়।
❏ ফতওয়ায়ে শামীর পঞ্চম খণ্ড কিতাবুল কারাহিয়া اللبس শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
قَالَ فِي فَتَاوَى الْحُجَّةِ وَتُكْرَهُ السُّتُورُ عَلَى الْقُبُورِ اهـ. وَلَكِنْ نَحْنُ نَقُولُ الْآنَ إذَا قَصَدَ بِهِ التَّعْظِيمَ فِي عُيُونِ الْعَامَّةِ حَتَّى لَا يَحْتَقِرُوا صَاحِبَ الْقَبْرِ، وَلِجَلْبِ الْخُشُوعِ وَالْأَدَبِ لِلْغَافِلِينَ الزَّائِرِينَ، فَهُوَ جَائِزٌ لِأَنَّ الْأَعْمَالَ بِالنِّيَّاتِ.
-‘‘ফত্ওয়ায়ে হুজ্জাতে আছে যে, কবরে গিলাফ চড়ান মাকরুহ। কিন্তু আমি বলতে চাই যে, বর্তমান কালে যদি সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে সম্মানবোধ প্রত্যাশা করা হয়, যাতে কবরবাসীর প্রতি অবজ্ঞা করা না হয় বরং উদাসীন ব্যক্তিদের মনে আদব ও ভয়ের সৃষ্টি হয়, তাহলে গিলাফ চড়ান জায়েয। কেননা আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’’ ১৯৯
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬৩।}
ফত্ওয়াযে শামরি এ ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহর ওলীগণের শান-মান প্রকাশ করার জন্য যে কোন বৈধ কাজ জায়েয। গিলাফ চড়ানোর গোড়ায় কথা হলো যে, হুযুর ﷺ'র পবিত্র যুগেও পবিত্র কাবা ঘরে গিলাফ ছিল। তিনি (ﷺ) এটা নিষেধ করেননি। শত শত বছর থেকে হুযুর ﷺ'র রওযা পাকের উপর সবুজ রং এর রেশমী চাদর চড়ানো আছে, যা খুবই মূল্যবান। আজ পযর্ন্ত কেউ একে নাজায়েয বলেননি। মকামে ইব্রাহীম অর্থাৎ যেই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত খলীল (عليه السلام) কাবা শরীফ তৈরী করেছিলেন, সেই পাথরের উপরও গিলাফ চড়ানো আছে এবং ইমারত তৈরী করা হয়েছে। খোদার কি শান! নজদী ওহাবীরাও ওগুলোকে পূর্ববৎ রেখে দিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, এগুলোর উপর কেন গিলাফ চড়ানো হলো? নিশ্চয় এসবের মর্যাদার জন্য তা করা হয়েছে। অনুরূপ আওলিয়া কিরামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাঁদের কবর সমূহের উপরও গিলাফ ইত্যাদি মুস্তাহাব।
❏ তফসীরে রুহুল বয়ানের দশ পারায় সূরা তওবার আয়াত ২০০
{সূরা তাওবাহ, আয়াত নং-১৮}
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ
এর ব্যাখ্যা প্রসংগে বর্ণিত আছে-
فَبِنَاءَ الْقَباب عَلَى قُبُوْرِ الْعُلَمَاءِ وَالْأَوْلِيَاءِ وَالصَّلحَاءِ وَوَضْعُ السَّتُوْرِ وَالْعَمَائِمْ وَالْثِّيَابِ عَلَى قَبُوْرِهِمْ اَمْرٌ جَائِزٌ إِذَا كَانَ الْقَصْد بِذَلِكَ التَّعْظِيم فِى أَعْيُنِ العَامَّةِ حَتَّى لَا يَحْتَقِرُوْا صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ.
-‘‘উলামা, আওলিয়া ও পুণ্যা্মাদের কবরসমূহের উপর ইমারত তৈরী করা এবং গিলাফ, পাগড়ী, চাদর চড়ানো জায়েয, যদি এর দ্বারা, সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে তাঁদের সম্মান প্রকাশ এবং লোকেরা যেন তাঁদেরকে নগণ্য মনে না করে, এ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।’’ ২০১
{ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪০০।}
(৩) সাধারণ মুসলমানদের কবরে প্রয়োজনবোধে এবং আল্লাহর ওলীদের মাযারসমূহে তাদের শান-মান প্রকাশার্থে বাতি জ্বালানো জায়েয। যেমন
❏ প্রসিদ্ধ কিতাব হাদিকায়ে নদিয়া শরহে তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া (মিসরী) দ্বিতীয় খণ্ডের ৪২৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
اخرج الشموع الى القبور بدعة واتلاف مال كذا فى البزازية وهذا كله اذا حلا عن فائدة واما اذا كان موضع القبور مسجد او على طريق او كان هناك احد جالسا او كان قبر ولى من الاولياء او عالم من المحققين تعظيما لروحه اعلاما للناس انه ولى ليتركوا به ويدعواالله تعالى عنده فيستجاب لهم فهو امر جائز .
-‘‘কবরসমূহে বাতি নিয়া যাওয়া বিদ্আত এবং অপব্যয়। অনুরূপ ফত্ওয়ায়ে বযাযিয়াতেও উল্লেখিত আছে যে, এসব নির্দেশ তখনই প্রযোজ্য, যখন অনর্থক করা হবে। কিন্তু যদি কবরস্থানে মসজিদ হয় বা কবরটা রাস্তার পার্শ্বে হয় বা ওখানে কেউ বসে আছেন এমন হয়, অথবা যদি কোন ওলী বা কোন বিশিষ্ট আলিমের কবর হয়, তাহলে তাঁদের আ্মার প্রতি সম্মানের জন্য এবং জনগণের অবগতির জন্য, যাতে এটা ওলীর কবর বুঝতে পেরে ফয়েয হাসিল করতে পারে এবং ওখানে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারে, বাতি জ্বালানো জায়েয।’’ ২০২
{আব্দুল গনী নাবলুসী, হাকিকাতুন নাদীয়া শরহে তরীকায়ে মুহাম্মদীয়্যাহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৪৯।}
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানে দশ পারার সূরা তওবার আয়াত-
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ
এর ব্যাখ্যা প্রসংগে উল্লেখিত আছে-
وَكَذَا إِيْقَادُ القَنَادِيْلِ وْالْشَّمْع عِنْدَ قَبُوْرِ الْأَوْلِيَاءِ وَالصَّلْحَاءِ من باب التعظيم وَالْإِجْلاَلِ اَيْضًا لِلْاَوْلِيَاءِ فَالْمَقْصَد فِيْهَا مَقْصَدَ حَسَنَ. وَنَذَرَ الزَّيْتِ وَالشَّمْعِ لِلْاَوْلِيَاءِ يُوْقَدُ عِنْدَ قُبُوْرِهِمْ تَعْظِيْمًا لَهُمْ وَمُحَبَّةَ فِيْهِمْ جَائِزٌ اَيْضًا لَا يَنْبَغِى النَّهِى عَنْهُ.
-‘‘অনুরূপ আওলিয়া কিরাম ও পুণ্যা্মাদের কবরের কাছে তাঁদের শান-মানের জন্য প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালানো যেহেতু সঠিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, সেহেতু জায়েয এবং আওলিয়া কিরামের (মাযারের) জন্য তৈল ও মোমবাতি বা তাঁদের কবরের পার্শ্বে তাদেরই সম্মানার্থে জ্বালানো হয়। এ উদ্দেশ্যে মানত করা জায়েয। এ ব্যাপারে নিষেধ না করা উচিত।’’ ২০৩
{ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪০০।}
আল্লামা নাবলুসী (رحمة الله) স্বরচিত ‘কাশপুন নূর আন আসহাবিল কুবুর’ পুস্তিকায় একই বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। বিবেকও তাই বলে। অর্থাৎ এসব কাজ জায়েয, যেমন আমি গম্বুজের আলোচনায় বলেছি যে ওসব আওলিয়া কিরামের মাযারের শান-শওকতের দ্বারা প্রকৃত পক্ষে ইসলামেরই শান-শওকত প্রকাশ পায়। ওয়ারেজী আলিমের উন্নতমানের পোশাক পরিচ্ছেদ করা উচিত। ঈদের দিন প্রত্যেক মুসলমানের ভাল কাপড় পরিধান করা ও সুগন্ধি ইত্যাদি লাগানো সুন্নাত কেন জানেন? যাতে, তার সাথে আলিংগন করতে লোক আগ্রহান্বিত হয়। এতে বোঝা গেল, যার সাথে সাধারণ মুসলমানদের সম্পর্ক, তার উচিৎ পরিপাটি অবস্থায় থাকা। আওলিয়া কিরামের মাযারসমূহ আল্লাহর বান্দাদের যিয়ারতের স্থান। তাই ওগুলোকেও পরিপাটি অবস্থায় রাখা বাঞ্ছনীয়।
আমি নজদী ওহাবীদের আমলে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে দেখি কাবা শরীফের চারিদিকে বৃত্তাকারে অনেক বিজলী বাতি জ্বলছে এবং হাতিম শরীফের দেয়ালেও আলো ছিল। ঠিক কাবা শরীফের দরজার সামনে চার চারটি আলোকবর্তিকা জ্বালানো হতো। যখন মদীনা শরীফে এলাম সেখানে রওযা পাককে কাবা শরীফ থেকেও আলোকোজ্জ্বল দেখলাম। ওখানকার বাল্বগুলো খুবই প্রখর ও উজ্জ্বল ছিল। মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি ও মহত্ব প্রকাশ করার জন্যই এর আয়োজন। আওলিয়া কিরামের মাযারসমূহেও অনুরূপ আলোর ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কি? আজকাল বিয়ে শাদী উপলক্ষে বাড়ীঘর আলোকসজ্জিত করা হয়ে থাকে। অনেক সময় সময় তৈলের প্রদীপও জ্বালানো হয়, যার জন্য অনেক আগের কথা, দেওবন্দীরা মুরাদাবাদে জমিয়তে উলামার এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, যেখানে চোখ ঝলসানো বিজলী বাতি লাগানো হয়েছিল। আমার মনে হয় কমপক্ষে দেড়শ টাকা (তৎকালিন) বিজলীর জন্য খরচ হয়েছিল। এটা কেবল সমবেত জনতাকে খুশী করার জন্যই করা হয়েছিল। ধর্মীয় সভা-সমিতিতে রংবেরংগের পতাকা দ্বারা সজ্জ্বিত করা হয় এবং ওয়ায়েজীনের গলায় ফুলের মালা দেয়া হয়। কই, এগুলোকেত না অপব্যয় বলা হয়, না হারাম আখ্যা দেয়া হয়। তাই উরসের সমাবেশ যেহেতু ধর্মীয় সমাবেশ, সেহেতু তথায়ও এসব কাজ জায়েয।
━━━━
No comments