সুক্ষ্ম রহস্য
❏ আল্লামা মোল্লা আবদুর রহমান ইবন মোহাম্মদ দামেশকী (رحمة الله) ‘রিসালায়ে নাসিখ ও মানসুখ (رساله ناسخ ومنسوخ) নামক পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন-
وَمَا اَدْرِىْ مَا يُفْعَلُ بِىْ وَلاَبِكُمْ نُسِخَ بِقَوْلِهِ اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ
অর্থাৎ- অর্থাৎ مَااَدْرِىْ الخ. আয়াতটি اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে।
❏ ‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
لَمَّا َنَزلَتْ هَذِهِ الْايَةُ فَرِحَ الْمُشْرِ كُوْنَ فَقَالُوْا وَاللاَّتُ وَالْعُزَّى مَا اَمَرَنَا وَاَمْرُ مُحَمَّدٍ اِلاَّوَاحِدً اوَمَالَهُ عَلَيْنَا مِنْ مَّزِيَّةٍ وَفَضْلٍ لَوْلاَ اَنَّهُ مَابْتَدَعَ مَا يَقُوْلُهُ لاَخْبَرَهُ الَّذِىْ بَعَثَهُ بِمَا يُفْعَلُ بِهِ فَاَنْزَلَ اللهُ عَزَّوَجَلَّ لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ (الاية) فَقَالَتِ الصَّحَبَةُ هَنِيْئًالَكَ يَانَبِىَّ اللهِ قَدْ عَلِمْتَ مَا يَفْعَلُ بِكَ فَمَا ذَا يَفْعَلُ بِنَا فَانْزَلَ اللهُ لِيُدْخِلَ الْمُؤْ مِنِيْنَ والْمُؤْمِنِاتِ جَنَّتِ (الاية) وَاَنْزَلَ وَبَشِّرِ الْمُؤْ مِنِيْنَ بِاَنَّ لَهُمْ مِنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيْرًا وَهَذَا قَوْلُ اَنْسٍ وَقَتَادَةَ وَعِكِرَمَةَ قَالْوا اِنَّمَا هَذَا قَبْلَ اَنْ يُّخْبَرَ بِغَفْرَانِ ذَنْبِهِ وَاِنَّمَا اُخْبِرَ بِغَفْرَانِ ذَنْبِهِ عَامَ الْحُدَيْبِيَّةِ فَنُسِخَ ذَلِكَ
অর্থাৎ- যখন আয়াতটি নাযিল হয়, তখন মুশরিকগণ খুশী হয়ে বলতে লাগলো লাত ও উয্যা মূর্তিদ্বয়ের শপথ! আমাদের ও মুহাম্মদ (ﷺ) এর একই অবস্থা; আমাদের উপর তাঁর কোন প্রাধান্য বা অন্য কোন মর্যাদা নেই। যদি রাসূল (ﷺ) কুরআনের কালামসমূহে নিজেই রচনা করে না বলতেন, তাহলে তার প্রেরক খোদা তা’আলা অবশ্যই বলে দিতেন যে, তাঁর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবেন। তখন আল্লাহ তা’আলা لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ الخ. আয়াতটি নাযিল করলেন। তখন সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আপনাকে মুবারকবাদ জানাই, আপনি তো জেনে ফেললেন, আপনার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আমাদের কি গতি হবে? তখন আল্লাহ তা’আলা
لِيُدْخِلَ الْمُؤْ مِنِيْنَ َوالْمُؤْمِنِاتِ جَنَّتِ
(আল্লাহ মুসলমান পুরুষ ও স্ত্রীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন) আয়াতটি নাযিল করলেন। এবং
وَبَشِّرِ الْمُؤْ مِنِيْنَ بِاَنَّ لَهُمْ مِنَ اللهِ فَضْلاً كَبِيْرًا
(মুমিনদেরকে এ শুভ সংবাদ দিন যে, তাঁদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবাণী আছে) আয়াতটিও নাযিল করলেন।
❏ হযরত আনাস, কাতদা ও ইকরামা (رضي الله عنه) এ মত পোষণ করেন। তাঁদের অভিমত হলো এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ওই আয়াতের আগে, যে আয়াতে রাসূল (ﷺ)-এর মাগফিরাতের খবর দেয়া হয়েছে। রাসূল (ﷺ) হুদায়বিয়ার সন্ধির বছরই তাঁকে এ খবর দেয়া হয়েছিল। সুতরাং, এ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে।)
{ইমাম খাযেন, তাফসীরে খাযেনঃ ২
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন لاَاَدْرِىْ আয়াতটি একটি ‘বিবরণাত্মক বাক্য’ এবং খবর বা বিবরণ রহিত হতে পারে না। এর কয়েকটি উত্তর আছে প্রথমতঃ উলামায়ে কিরামের অনেকেই খবর রহিত হওয়ার বৈধতার সপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন,
❏ যেমন وَاِنْ تُبْدُوْا الخ আয়াতটি لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا الخ আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে।
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৮৬, পারাঃ ৩}
❏ অনুরূপ لاَاَدْرِىْ الخِ আয়াতটিকে হযরত আব্বাস, আনাস ও ইবন মালিক اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ الخ আয়াত দ্বারা রহিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
{ক. ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ১০/৯ পৃ.
খ. ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে দুররে মানসূরঃ ৭/৩৭৭-৩৭৮ পৃ.
গ. ইমাম আবুস সাউদঃ তাফসীরে আবুস সাউদঃ ৬/৬৯ পৃ.}
(তাফসীরে কবীর, দুররে মনসুর ও আবুস সাউদ দ্রষ্টব্য)
দ্বিতীয়ত এ আয়াতে قُلْ لاَاَدْرِىْ শব্দ দ্বারা যেহেতু নির্দেশ বুঝায় সেহেতু এর সাথেই রহিত হওয়ার ব্যাপাটি সম্পর্কিত।
{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১৮৩, পারাঃ ২}
তৃতীয়তঃ কোন কোন আয়াত আকারের দিক দিয়ে বিবৃতিমূলক বাক্যের মত দেখা যায়, কিন্তু অন্তনির্হিত তাৎপর্যের দিক দিয়ে বিবৃতিমূলক বাক্যের মত দেখা যায়, কিন্তু অন্তনির্হিত তাৎপর্যের দিক থেকে ‘আদেশসূচক বাক্য’ রূপে গণ্য হয়।
যেমন كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ – لِلَّهِ عُلىَ النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ.{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ৯৭, পারাঃ ৪} ইত্যাদি।
এ ধরনের আয়াত সমূহ রহিত হওয়া জায়েয। চতুর্থতঃ এ আপত্তিটা আমাদের উপর প্রযোজ্য নয়, বরং সে সব তাফসীর ও হাদীছ সম্পর্কে প্রযোজ্য, যা দ্বারা ‘খবর’ রহিত হওয়ার বিষয় প্রমাণিত হয়েছে।
যদি এ আয়াতের উপরোক্ত মর্মার্থ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে আয়াতের বাহ্যিক শাব্দিক অর্থ অনেক হাদীছের বিপরীত হবে।
❏ হুযুর আলাইসি সালাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রশংসার ঝান্ডা لِوَ اءُ الْحَمْدِ আমার হাতেই থাকবে।’
হযরত আদম আলাইহিস সালাম) ও সকল আদম সন্তান-সন্ততি আমার পতাকাতলে অবস্থান গ্রহণ করবেন। শাফাআতে কুবরা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আমিই সুপারিশ করবো। আমার হাউয এ রকম হবে, এর পানপাত্র এ রকম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
❏ হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) বেহেশতী ও হযরত হাসান ও হুসাইন (رضي الله عنه) বেহেশতে নওজোয়ানদের নেতা, হযরত ফাতিমা যুহরা (رضي الله عنه) জান্নাতে মেয়েদের নেত্রী। কাউকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘তুমি জাহান্নামী।’ জনৈক ব্যক্তি খুবই উত্তমরূপে জিহাদ করছিল, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) ফরমালেন ‘সে জাহান্নামী। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে, সে আত্মহত্যা করেছিল।
যদি নাউযুবিল্লাহ! রাসূল (ﷺ)-এর নিজের খবর না থাকে, তাহলে নিজের ও অন্যান্যদের এসব খবর কিভাবে শোনাচ্ছেন? রাসূল (ﷺ) যার ঈমান রেজিষ্ট্রি করবেন, তিনি কামিল ঈমানদার। এখানে আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু বক্তব্য সংক্ষেপণ করার উদ্দেশ্যে এখানে ক্ষান্ত হলাম। খোদা সবাইকে বিষয়টি উপলব্ধি করার শীক্ত দান করুন। আমীন।
(৯) لاَ تَعْلَمُهُمْ . نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ.
-‘‘আপনি তাদেরকে জানেন না, আমি তাদেরকে জানি।’’
{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১০১,পারাঃ ১১}
এ আয়াতে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণ আরও একটি প্রমাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করে বলেন যে রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে আগত মুনাফিকদেরকে রাসূল (ﷺ) চিনতেন না। তাই ইলমে গায়বের প্রশ্ন উঠতে পারে কিভাবে? তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, এ আয়াতের পরেই وَلِتَعْرِ فََهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ.
(এবং নিশ্চয় তাদের কথার ধরন থেকে তাদেরকে চিনে ফেলবেন)
{সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ৩০, পারাঃ২৬}
আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। সুতরাং, এ আয়াতটি রহিত হিসেবে গণ্য হয়। অথবা এরকম ব্যাখ্যাও হতে পারে যে আমি (আল্লাহ বাতলিয়ে না দিলে আপনি (হে নবী (ﷺ)) তাদেরকে চিনতেন না।
❏ ‘তাফসীরে জুমালে’ এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে লিখা হয়েছেঃ
فَاِنْ قُلْتَ كَيْفَ نُفِىَ عَنْهُ عِلْمٌُ بِحَالِ الْمُنَافِقِيْنَ وَاَثْبَتَهُ فِىْ قَوْلِهِ تَعَالَى وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ فَالْجَوَابُ اَنَّ اَيَةَ النَّفِىَ نَزَلَتْ فَبْلَ اَيَةِ الْاِثْبَاتِ
অর্থাৎ- প্রশ্ন করতে পারেন যে, রাসূল (ﷺ) কর্তৃক মুনাফিকদের অবস্থা জানার বিষয়টি কেন অস্বীকার করা হলো? অথচ وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ. আয়াতে তাঁর জানার স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। এর জওয়াব হলো অস্বীকৃতিসূচক আয়াতটি স্বীকৃতিসূচক আয়াতের আগে অবতীর্ণ হয়েছিল।
❏ একই ‘জুমালে’ وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ. আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
فَكَانَ بَعْدَ ذَلِكَ لاَيَتَكَلًَّمُ مُنَافِقً عِنْدَ النَّبِىِّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اِلاَّعَرَفَهُ وَيَسْتَدِلُّ عَلَى فَسَادِ بَاطِنِهِ وَنِفَاقِهِ
অর্থাৎ- আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মুনাফিকদের রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে কথা বলতেই রাসূল (ﷺ) তাদরেকে চিনে ফেলতেন এবং তাদের অন্তরের অসৎ উদ্দেশ্য ও কপটতার পরিচায়ক প্রমাণও উপস্থাপিত করতেন।
❏ ‘তাফসীরে বায়যাবীতে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে লিখা আছেঃ
خَفِىَ عُلَيْكَ حَالُهُمْ مَعَ كَمَالِ فِطْنَتِكَ وَصِدْقِ فَرَاسَتِكَ
অর্থাৎ- আপনার পূর্ণবোধশক্তি ও মানুষ চিনার সঠিক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাদের (মুনাফিকদের) অবস্থা আপনার নিকট গোপন রয়ে গেছে।
{ইমাম নাসিরুদ্দিন বায়যাভীঃ তাফসিরে বায়যাভিঃ ৩/১৬৯ পৃ.}
এ তাফসীর থেকে বোঝা গেল যে, এ আয়াতে অনুমান ও আন্দাজের ভিত্তিতে জানার বিষয়টির অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। আয়াতের এ ধরনের ব্যাখ্যাবলী গ্রহণ করা না হলে, এটা সমস্ত হাদীছের বিপরীত হয়ে যাবে, যেগুলোতে একথা প্রমাণিত যে হুযুর আলাইহস সালাম মুনাফিকদেরকে চিনতেন, কিন্তু জেনে শুনেও তাদের অবস্থা গোপন করতেন।
❏ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আইনী’র ৪র্থ খন্ডের ২২১ পৃষ্ঠায় হযরত ইবন মসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছেঃ
خَطَبَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ يَوْمَ الْجَمْعَةِ فَقَالَ اُخْرُجْ يَافُلاَنُ فَاِنَّكَ مُنَافِقٌُ فَاَخْرَجَ مِنْهُمْ نَاسًا فَفَضَحَهُمْ
-‘‘ রাসূল (ﷺ) জুমা’র দিন খুতবা পাঠ করছিলেন। অতঃপর নাম উল্লেখপূর্বক বললেন, হে অমুক, বের হয়ে যাও। কেননা, তুমি মুনাফিক। এ রকম করে অনেক ব্যক্তিকে অপদস্থ করে বের করে দিয়েছিলেন।’’
❏ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) রচিত ‘শরহে শিফা’ এর ১ম খন্ডের ২৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছেঃ
عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ كَانَ الْمُنَفِقُوْنِ مِنَ الرِّجَالِ ثَلَثَةَ مِاَئَةٍ وَمِنَ النِّسَاءِ مِاَئْةً وَّسَبْعِيْنَ
-‘‘হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে মুনাফিকদের পুরুষের সংখ্যা ছিল তিনশ, আর মহিলার সংখ্যা ছিল একশত সত্তর।’’
আমি ইতোপূর্বে ইলমে গায়বের সমর্থনে একটি হাদীছ পেশ করেছি।
❏ উক্ত হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন- ‘আমার সামনে আমার সমস্ত উম্মতকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি তাদের মধ্যে মুনাফিক, কাফির ও মুমিনগণকে চিহ্নিত করেছি। এতে মুনাফিকগণ আপত্তি উত্থাপন করলো। তখন তাদের আপত্তির জওয়াবে কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। বলা বাহুল্য, যাবতীয় দলীল সমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্যে এরূপ প্রায়োগিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন। অধিকন্তু, আয়াতে বর্ণিত বক্তব্য সাধারণত ক্ষোভ প্রকাশের জন্য করা হয়ে থাকে। বাপ নিজ শিশুকে শস্তি দিবার সময় কেউ যদি রক্ষা করে তখন তিনি বলেন, এ অসভ্যকে তুমি চিন না, আমি ভালরূপে চিনি। এতে জ্ঞানের অস্বীকৃতি বুঝায় না।
(১০) وَلاَتُصَلِّ عَلَى اَحَدٍ مِّنْهُمْ مَاتَ اَبَدًا
❏ ‘‘তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে আপনি কখনও জানাযার নামায পড়বেন না।’’
{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৮৪, পারাঃ ১০}
❏ রাসূল (ﷺ) আবদুল্লাহ ইবন উবাই নামক কট্টর মুনাফিকের জানাযার নামায পড়েছিলেন কিংবা পড়তে চেয়েছিলেন। এমন সময় হযরত ফারূকে আজম (رضي الله عنه) নামায না পড়তে অনুরোধ করলেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) অনুরোধ রক্ষা করলেন না। তখনই উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, যেখানে তাঁকে মুনাফিকদের জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।
যদি তাঁর ইলমে গায়ব থাকতো, তাহলে তিনি মুনাফিকের জানাযার নামায পড়লেন কেন?
এর উত্তর হচ্ছে, হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এ মুনাফিকের নিকট একটু ঋণী ছিলেন, এবং তার ছেলে কিন্তু খাঁটি মুমিন ছিলেন। উক্ত মুনাফিক নিজে ওসীয়ত করে গিয়েছিল যে তার জানাযার নামায যেন রাসূল (ﷺ) পড়ান। সে সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সুতরাং, তখনকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত অনুমতি অনুসারে রাসূল (ﷺ) আমল করেছিলেন।
তাফসীরে কবীর ও রূহুল বয়ানে উল্লেখিত আছে যে, তার ওসীয়ত দ্বারা তার তাওবাই প্রমাণিত হয়।
{ইমাম ফখরুদ্দিন রাজীঃ তাফসিরে কাবিরঃ ৬/১১৬পৃ.}
শরীয়তের হুকুম বাহ্যিক দিকের উপর বর্তায়। রাসূল (ﷺ) সে অনুযায়ী আমল করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ছিল না যে তাঁর হাবিব দুশমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হোক। তাই কুরআন করীম হযরত ফারুক (رضي الله عنه) এর মতের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। মোটকথা, এ বিষয়টি ইলমে গায়বের সহিত মোটেই সম্পৃক্ত নয়। আবদুল্লাহর মুনাফিক হওয়ার বিষয়টি সবার জন্য ছিল। তবুও তার জানাযার নামায আদায়ের মধ্যে অনেক কল্যাণময় দিক ছিল। দয়াময়ের বাদন্যতা ও মহানুভবতা অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ পেয়ে যায়। তা’ না হলে ইহা কিভাবে সম্ভবপর হতে পারে যে হযরত ফারুকে আজম (رضي الله عنه) যা’ জানতে পারলেন, তা’ হুজুর আলাইহিস সালাম জানতে পারলেন না?
(১১) وَيَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الرُّوْحِ. قُلِ الرَّوْحُ مِنْ اَمْرِ رَبِّىْ وَمَا اُوْتِيْتُمْ مِنَ الْعِلْمِ اِلاَّقَلِيْلاً
‘‘আপনার কাছে এরা আত্মার কথা জিজ্ঞাসা করছে, আপনি বলুন আত্মা হচ্ছে খোদার হুকুমে সৃষ্ট সূক্ষ্ম বস্তু। এবং তোমরা মাত্র যৎসামান্য জ্ঞানই লাভ করেছ।’’
{সূরাঃ বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৮৫, পারাঃ ১৫}
বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণ এ আয়াতটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে বলেন, আত্মা কি, রাসূল (ﷺ)-এর সে জ্ঞান ছিল না। সুতরাং, হুযুর (ﷺ) সম্পূর্ণ ইলম গায়বের অধিকারী হন নি। এখানে তিনটি বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার।
প্রথমতঃ এ আয়াতে এ কথা কোথায় আছে যে ‘আমি (আল্লাহ) হুযুর আলাইহিস সারামকে আত্মার জ্ঞান দান করিনি”? আর হুজুর আলাইহিস সালামই বা কোথায় বলেছেন, ‘আত্মা সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই। সুতরাং, এ আয়াতকে আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞানের অস্বীকৃতিসূচক দলীল হিসেবে গ্রহণ করাটাই ভুল। এখানে তো প্রশ্নকারী কাফিরদেরকে বলা হয়েছে, ‘তোমাদেরকে যৎসামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে, আত্মার মূলতত্ত্বের জ্ঞান তোমাদের নেই।’
দ্বিতীয়তঃ
❏ হযরত কিবলায়ে আলম শাইখ মেহর আলী শাহ সাহেব ফাযেলে গোলড়বী (رحمة الله) তার রচিত ‘সাইফে চিশতীয়া নামক কিতাবে হযরত মুহিউদ্দীন ইবন আরবীর উদ্ধৃতি দিয়েঃ
قُلِ الرَّوْحُ مِنْ اَمْرِ رَبِّىْ
এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ বলে দিন, রূহ আমার প্রতিপালকের আদেশে সৃষ্ট।
অর্থাৎ আলম বা জগত অনেক আছে। যথা ‘আলমে আনাসির’ (জড় জগত), ‘আলমে আরওয়াহ’ (আত্মিক জগত) আলমে আমর, আলমে ইমকান’ ইত্যাদি সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম জগত। রূহ হচ্ছে আলমে আমরের অন্তভুর্ক্ত আর তোমরা হচ্ছ আলমে আনাসিরের আওতাভুক্ত। তাই তোমরা এর মূলতত্ত্ব বা স্বরূপ জানেত পারবে না। কেননা, (ওহে কাফিরগণ) তোমরা তো যৎকিঞ্চিত জ্ঞানের অধিকারী মাত্র।
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ আয়াত
لاَتَدْرِ كُهُ الْاَ الاْبَصَارُ وَهُوَيُدْرِكُ الْاَبْصَارَ
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১০৩, পারাঃ ৭}
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছেঃ
لاَنَّهُ تَجَاوَزَفِىْ تِلْكَ اللَّيْلَةِ عَنْ عَالَمِ الْعَنَاصِرِ ثُمَّ عَنْ عَالَمِ الطَّبْعِيَّةِ ثُمْ عَنْ عَالَمِ الْاَرْوَاحِ حَتَّى وَصَلَ اِلَى عَالَمِ الْاَمْرِوَعَيْنُ النَّأسِ مِنْ عَالَمِ الْاَجْسَامِ فَاَنْسَلَخَ عَنِ آلْكُلِّ وَرَائَى رَبَّهُ بِالْكُلِّ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ) মিরাজের রাতে ‘আলমে আনাসির’ থেকে অগ্রসর হয়ে ‘আলমে তাবীয়াত’ অতঃপর ‘আলমে আরওয়াহ’ অতিক্রম করে সর্বশেষে ‘আলমে আমর পর্যন্ত পৌঁছেন। শরীরের এ চর্মচোখ ‘আলমে আজসামের’ অন্তভুর্ক্ত বিধায় তিনি (ﷺ) এ জগতের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক হয়ে যান এবং মহান আল্লাহ তা’আলাকে তাঁর সর্বসত্ত্বা দিয়ে অবলোকন করেন।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৩/১০০ পৃ.}
এ থেকে বোঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ) মিরাজের রাতে শুধু যে ‘আলমে আমর’ পরিভ্রমণ করেছেন, তা নয়, বরং নিজেও ‘আলমে আমরের’ অন্তভুর্ক্ত হয়ে যান এবং স্বীয় প্রতিপালককে অবলোকন করেন। আর সেই আলমে আমরের অন্তভুর্ক্ত হচ্ছে আত্মা বা রূহ। এমতাবস্তায় আত্মা রাসূল (ﷺ) কাছে গোপন থাকতে পারে কি? আমরা যেরূপ এ জগতের শারীরিক কাঠামোসমূহ দেখেই পরিচয় পাই, রাসূল (ﷺ)ও অনুরূপভাবেই আত্মার পরিচয় লাভ করেন। কারণ রূহও সে একই ‘আলমে আমর’ এর অন্তভুর্ক্ত।
❏ হযরত ঈসা (عليه السلام) অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক রূহ সম্পন্ন ছিলেন কেননা, হযরত মারয়াম (رضي الله عنه) ছিলেন মানবী, আর হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) হচ্ছেন রূহ। কুরআনেই আছে فَاَرْسَلْنَا اِلَيْهَا رُوْحَنَا (আমি হযরত মারয়ামের কাছে আমার রূহ অর্থাৎ জিব্রাইল (عليه السلام) কে পাঠিয়ে ছিলাম।) এবং তাঁর ঈসা (عليه السلام) সৃষ্টি হয়েছিল হযরত জিব্রাইলের ফুঁক থেকে। এ জন্য রূহ ও মানব এ উভয়ের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান আছে তাঁর মধ্যে।
❏ ‘ফুতুহাতে মক্কিয়া’ কিতাবের ৫৭৫ অধ্যায়ে শাইখ আকবর (رحمة الله) ফরমানঃ
فَكَانَ نِصْفَهُ بَشَرًا وَنِصْفُهُ الْاَخَرُرَوْحًا مُطَهَّرًا مَلَكًا لِاَنَّ جِبْرِيْلَ وَهَبَهُ لِمَرْيَمَ
অর্থাৎ- হযরত ঈসা (عليه السلام) হচ্ছেন অর্ধেক মানব এবং অপর অর্ধেক পূত পবিত্র আত্মবিশিষ্ট। কেননা তাঁকে জিব্রাইল (عليه السلام) হযরত মারয়ামের নিকট অর্পণ করেছেন।"
তাঁর সৃষ্টিও রাসূল (ﷺ)-এর নুর থেকে। তাই রাসূল (ﷺ) হচ্ছেন যেন আপাদমস্তক রূহ (আত্মা)
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ لاَتُدْركُ الخ আয়াতের তাৎপর্য বিশেষণ প্রসঙ্গে আরও লিখা হয়েছেঃ
اَلْحَقِيْقَتُ الْمُحَمَّدِيَّهُ هِىَ حَقِيْقَةُ الْحَقَائِقِ وَهُوَ الْمَوْجُوْدُ الْعَامُّ الشَّامِلْ
-‘‘হাকীকতে মুহাম্মদীয়া সমস্ত হাকীকতের হাকীকত এবং উহাই সমগ্র সৃষ্টিতেই ব্যাপৃত।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৩/১০১ পৃ.}
সুতরাং, উক্ত আয়াতের অর্থ হল রূহ হচ্ছে, যা’ নির্দেশসূচক كُنْ ‘কুন’ এর ফলশ্রুতিতে সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট হয় এবং উহাই হচ্ছে হাকীকতে মুহাম্মদীয়া, যাঁর সৃষ্টি হলো সরাসরি মাধ্যম ছাড়াই আর বাকী সব কিছুর সৃষ্টি তাঁর নূর থেকে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, রাসূল (ﷺ) হচ্ছেন জগতের ‘হাকীকী রূহ’।
❏ ‘তাফসীরে কবীরে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ এখানে ‘রূহ’ শব্দ প্রয়োগ করে কুরআন বা হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। কাফিরগণ প্রশ্ন করেছিল, কুরআন কি, কবিতা, না মনগড়া কাহিনী? বা জিব্রাইল কে, এবং এখানে কিভাবে আসেন তিনি? উত্তর দেয়া হয়েছে, কুরআন হচ্ছে খোদার নির্দেশাবলী, কবিতা কিংবা যাদু নয়। আর জিব্রাইল (عليه السلام) খোদার হুকুমেই আসেন।
❏ কুরআনেই বলা হয়েছে وَمَانَتَنَزَّلُ اِلاَّ بِاَمْرِرَبِّك. (আপনার প্রভুর হুকুম ছাড়া তিনি অবতরণ করেন না।)
{সূরাঃ মায়াহিম, আয়াতঃ ৬৪, পারাঃ ১৬}
❏ উক্ত তাফসীরে কবীরে আরও বলা হয়েছেঃ
فَاِذَا كَانَ مَعْرِفَتُ اللهِ تَعَالَى مُمْكِنَةً بَلْ حَاصِلَةً فَاَىُّ مَانِعٍ يَمْنَعُ مِنْ مَّعْرِفَّةِ الرُّوْحِ
রাসূল (ﷺ) যখন খোদাকে চিনলেন, রূহকে কেন চিনবেন না?
{ইমাম ফখরুদ্ধীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৭/৩৯২ পৃ.}
তৃতীয়তঃ তাফসীরকারক ও হাদীছবেত্তাগণ সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে রাসূল (ﷺ)-এর রূহের জ্ঞান ছিল।
❏ ‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
قِيْلَ اِنَّ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ عَلِمَ مَعْنَى الرُّوْحِ لَكِنْ لَّمْ يُخْبِرْ بِهِ لِاَنْ تَرْكَ الْاَخْبَارِ كَانَ عَلَمًا لِنُبُوَّتِهِ وَالْقَوْلُ الْاَصَحُّ اَنَّ اللهَ اِسْتَاثَرَ بِعِلْمِ الرُّوْحِ
অর্থাৎ- বলা হয়েছে যে, নবী আলাইহিস সালামের রূহের স্বরূপ জানা ছিল, কিন্তু এ সম্পর্কে কিছু বলেন নি। কেননা, না বলাটাই ছিলো তাঁর নবুওয়াতের আলামত। এ প্রসঙ্গে সর্বাধিক সঠিক মত হলো যে রূহের জ্ঞান আল্লাহর সহিত বিশেষভাবে সম্পর্ক যুক্ত।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে লুবাবুত তা’ভীলঃ ৩/১৪৫ পৃ.}
এ ইবারতে রূহ সম্পর্কিত জ্ঞানের স্বীকৃতি প্রদানকারীকে ‘মুশরিক’ বলা হয়নি বা তাদের মতকেও ভুল বলা হয়নি।
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
جَلَّ مَنْصَبُ حَبِيْبِ اللهِ اَنْ يَكُوْنَ جَاهِلاً بِالرُّوْحِ مَعَ اَنَّهُ عَالِمٌُ بِاللهِ وَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَيْهِ بِقَوْلِهِ وَعَلَّمَكَ مَالَمْ تَكُنْ تَعْلَمْ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ) রূহ সম্পর্কে অনবহিত, অথচ আল্লাহ সম্পর্কে অবগত- এ ধরনের অশোভন উক্তি রাসূল (ﷺ) ক্ষেত্রে খাটে না। মহা প্রভু তাঁর প্রতি স্বীয় অসীম অনুগ্রহের উল্লেখপূর্বক ইরশাদ করেছেন যে, ‘যা’ কিছু আপনি জানতেন না, তা আপনাকে অবহিত করেছি’।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৫/২৩৫ পৃ.}
❏ ‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আছেঃ
وَقِيْلَ كَانَ السَّوَالُ عَنْ خَلْقِ الرُّوْحِ يَعْنِىْ هُوَ مَخْلُوْقَّ اَمْ لاَ وَقَوْلُهًُ مِنْ اَمْرِ رَبِّىْ دَلِيْلُ خَلْقِ الرُّوْحِ فَكَانَ جَوَاباً
অর্থাৎ- বলা হয়েছে যে, এখানে প্রশ্নটি ছিল রূহের সৃষ্টি সম্পর্কে। অর্থাৎ রূহ সৃষ্টির অন্তভুর্ক্ত কিনা? আল্লাহর ইরশাদ مِنْ اَمْرِ رَبِّىْ দ্বারা রূহ সৃষ্ট বলেই প্রমাণিত হল। সুতরাং, এটি হচ্ছে তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৭২৭ পৃ.}
এ ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, উক্ত আয়াতে রূহের জ্ঞান থাকা, না থাকার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি, বরং এখানে আলোচনা হয়েছে রূহের মাখলুক (সৃষ্ট) হওয়া সম্পর্কিত বিষয়ে।
❏ ‘মাদারেজুন নাবুওয়াতের’ দ্বিতীয় খন্ডের ৪০ পৃষ্ঠায়ঃ
وصل ايزارسانى كفار فقراء صحابه را. শীর্ষক পরিচ্ছেদে শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেনঃ
چه گونه جرأت كند مؤمن عارف كه نفى عالم بحقيقت روح ازسيد المرسلين وامام العار فين كند وداده است اورا حق سبحانه علم ذات وصفات خود وفتح كرده بر ائے او فتح مبين ازعلوم اولين وآخرين روح انسانى چه باشد كه درجنب جامعيت وے قطره ايست از دريا وذره ايست ازبيدا
অর্থাৎ- একজন ‘আরিফ’ মুমিন রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে রূহের মৌলতত্ত্ব সম্পর্কিত জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করার ধৃষ্টতা কিরূপে প্রদর্শন করতে পারেন? যখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে (হুযুর) স্বীয় সত্ত্বা ও গুণাবলীর জ্ঞান দান করেছেন, তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল জ্ঞানের জ্ঞানভান্ডার তাঁর জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তাঁর ব্যাপক জ্ঞানের তুলনায় মানবাত্মা সম্পর্কিথ জ্ঞানের আর কতটুকুই বা বিশেষত্ব থাকতে পারে। এ’তো যেন সমুদ্রের এক কাতরা, বা সুবিস্তৃত প্রান্তরের একটি পরিমাণু সদৃশ মাত্র।
❏ সুবিখ্যাত ‘ইহয়াউল উলুম’ কিতাবে ইমাম গায্যালী (رحمة الله) লিপিবদ্ধ করেছেনঃ
وَلاَ تَظُنُّ اَنَّ ذَلِكَ لَمْ يَكُنْ مَكْشُوْفًا لِرَسُوْلِ اللهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَاِنَّ مَنْ لَّمْ يَعْرِفُ نَفْسَهُ فَكَيْفَ يَعْرِفُا للهُ سُبْحَانَهُ فَلاَ يَبْعُدُ اَنْ يَّكُوْنَ ذَلِكَ مَكْشُوْفًا لِبَعْضِ الْاَوْلِيَاءِ وَاَلْعُلَمَاءِ
-‘‘একথা মনে করবেন না যে, রাসূল (ﷺ)-এর নিকট রূহের রহস্য উৎঘাটিত হয়নি। কেননা, যে নিজেকে চিনতে পারে না, সে আল্লাহকে কিভাবে চিনতে পারে? কোন কোন ওলী ও আলেমে রব্বানীর নিকটও রূহের রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারটি বিচিত্র কিছু নয়।’’
{ইমাম গাজ্জালীঃ ইহইউ উলুমুদ্দীনঃ ১/১১১ পৃ. দারুল মা‘রিফ, বৈরুত।}
উপরোক্ত ভাষ্যসমূহ থেকে বোঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ)কে রূহের জ্ঞান দান করা হয়েছে। অধিকন্তু, তারই বদৌলতে কোন কোন আলেম ও ওলীও এজ্ঞান লাভ করেছেন। কিছু সংখ্যক লোক এটা অস্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু সে সম্পর্কে কোন দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন নি। উপরন্তু, কোন বিষয়ে স্বীকৃতি সূচক ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন বিবিধ দলীল পাওয়া গেলে স্বীকৃতিসূচক প্রমাণ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। উসুলের বিধিবদ্ধ নিয়মই হচ্ছে এরূপ, যা’ পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।
(১২)عَفَا اللهُ عَنْكَ لِمَا اَذِنْتَ لَهُمْ
অর্থাৎ- “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন” আপনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন কেন?
{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৪৩, পারাঃ ১০}
তাবুকের যুদ্ধে কোন কোন মুনাফিক মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে অংশ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। তাদের এ ছল-ছাতুরী রাসূল (ﷺ)-এর কাছে ধরা পড়েনি। তাই রাসূল (ﷺ) তাদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করার অনুমতি দিয়ে দেন। তাই এ আয়াতে কেন তিনি অনুমতি দিলেন সে কারণে তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করা হয়েছে। যদি রাসূল (ﷺ) ইলম গায়বের অধিকারী হতেন, তা’হলে আসল ব্যাপারটি তাঁর নিকট প্রকাশ হয়ে পড়তো।
উত্তরঃ এ আয়াতে হুযুর আলাাইহিস সালামকে না কোন ভর্ৎসনা করা হয়েছে, না তিনি তাদের চালবাজী সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। বরং রাসূল (ﷺ) তাদের অবস্থা জেনেও তাদের গোমর ফাঁস না করেই অনুমতি প্রদান করেছিলেন। তাই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, হে অপরাধীদের গোপনীয়তা রক্ষাকারী। আপনি তাদেরকে কেন অপদস্থ করলেন না? ভর্ৎসনা করা হয় ভুলত্রুটির জন্য। এখানে কোন ধরনের ত্রুটি হলো? عَفَا اللهُ (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন) হচ্ছে আশীর্বাদসূচক বাক্য; ভর্ৎসনার জন্য এ বাক্যটি প্রয়োগ করা হয়নি।
(১৩)وَيَسْئَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ اَيَّانَ مُرْسَهَا . فِيْمَ اَنْتَ مِنْ ذِكْرَهَا
-‘‘আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে এরা জিজ্ঞাসা করছে যে, উহা কোন সময়ের অপেক্ষায় আছে? এ তথ্যের সাথে আপনার কীই বা সম্পর্ক আছে?
{সূরাঃ নাযিআত, আয়াতঃ ৪২-৪৩, পারাঃ ৩০}
এ আয়াতকে বিরুদ্ধমতাবলম্বীগণ তাদের দাবীর সমর্থনে প্রমাণস্বরূপ উত্তাপন করে বলেন যে, কিয়ামত কখন হবে, এ সম্বন্ধে রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞান ছিল না। তাই তিনি সম্পূর্ণরূপে ‘ইলমে গায়ব’ এর অধিকারী হননি। বস্তুতঃ সঠিক কথা হলো যে আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ﷺ)কে এ জ্ঞানও দান করেছেন। তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের কয়েকটি প্রায়োগিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এক, এ আয়াতটি কিয়ামতের জ্ঞান দান করার পূর্বেই নাযিল করা হয়েছিল। দুই, এ উক্তি দ্বারা প্রশ্নকারীদের উত্তর দেয়া থেকে তাঁকে বিরত রাখাই উদ্দেশ্য, রাসূল (ﷺ) জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন নয়। তৃতীয়তঃ এ আয়াতে বলা হয়েছে اَنْتَ مِنْ ذِكْرَهَا অর্থাৎ আপনি নিজেই তো কিয়ামতের লক্ষণসমূহের অন্যতম। আপনাকে দেখেই তাদের জেনে নেওয়া উচিত যে কিয়ামত নিকটবর্তী। চতুর্থতঃ এখানে বলা হয়েছে, তাঁকে সে সব তথ্য পৃথিবীতে প্রকাশ করার জন্য পাঠানো হয়নি।
❏ ‘তাফসীরে সাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
وَهَذَا قَبْلَ اِعْلاَمِهِ بِوَقْتِهَا فَلاَيُنَافِى اَنَّهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَخْرُجْ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى اَعْلَمَهُ اللهُ بِجَمِيْعِ مُغَيِّبَاتِ الدُّنْيَا وَالْاَخِرَةِ
অর্থাৎ- এ আয়াতটি রাসূল (ﷺ)কে কিয়ামতের সময় সম্পর্কে অবহিত করার পূর্বেই নাযিলকৃত।
{ইমাম সাভীঃ তাফষীরে সাভীঃ ৬/২৩১-২৩২ পৃ.}
সুতরাং, এ বক্তব্যটি সে উক্তির বিপরীত নয়, যেখানে বলা হয়েছে ‘পৃথিবী থেকে রাসূল (ﷺ) বিদায় গ্রহণ করেন নি, ততক্ষণ না আল্লাহ তা’আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত জ্ঞান দান করেছেন।
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ আছেঃ
قَدْذَهَبَ بَعْضُ الْمَشَائِخِ اِلَى اَنَّ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَعْرِفُ وَقْتَ السَّاعَةِ بِاِعْلاَمِ اللهِ وَهُوَ لاَيُنَافِى الْحَصْرَ فِى الْاَيَةِ
অর্থাৎ- কোন কোন মাশায়িখ এ মত পোষণ করেন যে, আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক উক্ত সময় সম্পর্কে তাকে অবহিত করার ফলশ্রুতিতে তিনি (ﷺ) কিয়ামতের সময় সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং এ উক্তিটি এ আয়াতের অন্তর্নিহিত ‘সীমাবদ্ধতার সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২০/৩৮৭ পৃ.}
অর্থাৎ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, কিয়ামতের সময় সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহর জন্য খাস। মাশায়িখের উপরোক্ত উক্তিটি কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা জ্ঞাপক এ আয়াতটির বিপরীত নয়।)
❏ তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ ৯ম পারার
يَسْئَلُوْنَكَ كُاَنَّك حَفِىُّ عَنْهَا আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতেও এ ভাষ্যই উল্লেখিত আছে।
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১৮৭, পারাঃ ৯}
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৩/৩৭১-৩৭২}
পরিপ্রেক্ষিতেও এ ভাষ্যই উল্লেখিতর আছে। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পৃথিবীর পূর্ণ বয়স সত্তর হাজার বছর এবং এ তথ্যটি বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। তাই বোঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ)-এর কিয়ামতের জ্ঞান ছিল।
❏ তাফসীরে ‘খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
وَقِيْلَ مَعْنَاهُ فِيْمَا اِنْكَارٌُ لِسَوَالِهِمْ اَىْ فِيْمَا هَذَا السَّوَالُ ثُمَّ قَالَ اَنْتَ يَامُحُمَّدُ مِنْ ذِكْرَاهَا اَىْ مِنْ عَلاَمَا تِهَا لِاَنَّكَ اَخِرُ الرُّسُلِ فَكَفَا هُمْ ذَلِكَ دَلِيْلاً عَلَى دُنٌُوِهَا
অর্থাৎ- কারো কারো মতে فِيْمَا শব্দ দ্বারা কাফিরদের অবাঞ্ছিত প্রশ্নের অযৌক্তিকতার কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের এ আবার কোন ধরনের প্রশ্ন। অতঃপর বলেছেন- হে মুহাম্মদ (ﷺ)! আপনি নিজেই কিয়ামতের নির্দেশনাবলীর অন্যতম। কেননা আপনি হলেন সর্বশেষ নবী। সুতরাং, কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার প্রমাণ হিসাবে তাদের জন্য এতটুকুইতো যথেষ্ট।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ২/২৭৯ পৃ.}
❏ ‘তাফসীরে মাদারিকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
اَوْكَانَ رَسُوْلُ اللهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَزَلْ يَذْكُرُ السَّاعَةَ وَيَسْأَلُ عَنْهَا حَتَّى نَزَلَتْ فَهُوَ تَعَجُّبٌُ مِنْ كَثَرَةِ ذِكْرِهَا
অর্থাৎ- অথবা রাসূল (ﷺ) কিয়ামত সম্পর্কিত ব্যাপারে অনেক কিছু বর্ণনা করতেন এবং এ পসঙ্গে তাকে বিবিধ প্রশ্ন করা হতো। শেষ পর্যন্ত এ আয়াতটি অবতীর্ণ করা হয়।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫৪ পৃ.}
সুতরাং, এ আয়াতে কিয়ামত সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) এত অতিরিক্ত বর্ণনার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। এ আয়াতের মর্মার্থ হলো আপনি (ﷺ) কিয়ামতের আর কত বর্ণনা দিবেন।
❏ উক্ত তাফসীরে মাদারিকে এ আয়াত প্রসঙ্গে আরও উল্লেখিত আছেঃ
اَوْفِيْمَا اِنْكَارٌُ لِسَوَالِهِمْ عَنْهَا اَىْ فِيْمَا هَذَا لسُّوَالُ ثُمَّ قَالَ اَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا وَاَنْتَ اَخِرُ الْاَنْبِيَاءِ عَلاَمَةٌُ مِنْ عَلاَماَتهِاَ فَلاَ مَعْنَى لِسَوَالِهِمْ عَنْهَا
অর্থাৎ- অথবা, فِيْمَا শব্দ দ্বারা কাফিরদের অবান্তর প্রশ্নের অসারতার কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ প্রশ্নটিইবা কোন্ ধরনের। অতঃপর বলেছেন ‘আপনি এ কিয়ামতের চিহ্ন সমূহের একটি। সুতরাং, এমতাবস্থায় তাদের কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করার কীই বা অর্থ হতে পারে।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫৪ পৃ.}
এ আয়াতের মর্মার্থ হলো- কিয়ামত সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করাটা অহেতুক, আপনি নিজেই কিয়ামতের আলামত স্বরূপ। তবুও তারা কেন এ প্রশ্ন করে?
❏ ‘তাফসীরে মাদারিকে’ সে একই আয়াত প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছেঃ
قِيْلَ فِيْمَا اَنْتَ مِنْ ذِكْرَهَا مُتَّصِلٌُ بِالسَّوَالِ اَىْ يَسْئَلُوْ نَكَ عَنِ السَّاعَةِ اَيَّانَ مُرْسهْاَ وَيَقُوْلُوْنَ اَيْنَ اُنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا ثُمَّ اسْتَانَفَ فَقَالَ اِلَى رَبِّكَ
অর্থাৎ- এবং বলা হয়েছে যে, فِيْماَ فِيْمَا اَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا. এ অংশটুকুর সম্পর্ক হচ্ছে আয়াতে উক্ত প্রশ্নের সাথে। কাফিরগণ আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, কিয়ামত কখন হবে? এবং তারা এও বলে যে আপনি এ জ্ঞান কোত্থেকে পেলেন? এরপর আল্লাহ তা’আলা নিজের কথা পুনরারম্ভ করে বলেন اِلَى رَبِّكَ (এ জ্ঞান তার উৎস আল্লাহর দিকেই প্রত্যাগমন করে।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫৪ পৃ.}
এখন এ আয়াতের মর্মার্থ হলো কাফিরগণ জিজ্ঞাসা করছিলো এ জ্ঞান কোত্থেকে লাভ করলেন? তখন আল্লাহ তা’আরা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে। সুতরাং, আয়াতটি রাসূল (ﷺ) কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানেরই প্রমাণবহ।
❏ উপরোক্ত তাফসীর উক্ত আয়াত এর তাফসীরে আরও লিপিবদ্ধ আছেঃ
اِنَّمَاانْتَ مُنَذِرُمَنْ يَّخْشَهَا اَىْ لَمْ تُبْعَثْ ِلُتَعِّلَمُهْم بِوَقْتِ السَّاعَةِ اِنَّمَااَنْتَ الخ
অর্থাৎ- অর্থাৎ আপনাকে এ জন্য পাঠানো হয়নি যে, তাদেরকে কিয়ামতের সময় সম্পর্কে অবহিত করবেন।
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫৪ পৃ.}
এখন আলোচ্য আয়াতের আসল মতলব হলো কাফিরগণ যে বলে “যদি আপনি কিয়ামতের খবর দিতে পারেন তাহলে আপনি নবী, অন্যথায় নবী নন। এটা নিছক বাজে প্রলাপ বৈ আর কিছু নয়। কেননা, কিয়ামতের খবর দেয়াটা নবুওয়াতের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য সমূহের অন্তভুর্ক্ত নয়। নবীর জন্য যা জরুরী, তা হচ্ছে ধর্মের নির্দেশাবলীর প্রচার করা।
❏ মাদারিজুন নাবুওয়াতের দ্বিতীয় খন্ডে ৪০ পৃষ্ঠায়
ايذا راسانى كفار فقراء صحاب শীর্ষক পরিচ্ছেদে উল্লেখিত আছেঃ
وبعضے علماء علم ساعت نيز مثل ايں معنى گفته ان
অর্থাৎ কোন কোন আলেম রূহ সম্পর্কিত জ্ঞানের মত কিয়ামত সম্পর্কেও রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞান আছে বলে স্বীকার করেন।
(১৪)يَسْئَلُوْنَكَ كَاَنَّكَ خَفِىٌُّ عَنْهَا قُلْ اِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَاللهِ
অর্থাৎ- তারা আপনাকে এমনভাবে জিজ্ঞাসা করে যে কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান যেন আপনার নিজস্ব গবেষণালব্দ। আপনি তাদের বলে দিন যে, এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে।
{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ১৮৭, পারাঃ ৯}
বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণ এ আয়াতটি উপস্থাপন করে বলেন যে, কিয়ামত সম্বন্ধে রাসূল (ﷺ)-এর কোন জ্ঞান নেই। এর দুটি উত্তর রয়েছে। এক, এ আয়াতের মধ্যে কোথায় আছে যে হুযুর আলাাইহিস সালামকে কেয়ামতের জ্ঞান আল্লাহ দান করেন নি? এখানে তো শুধূ এতটুকুই বলা হয়েছে যে এ জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহই। এ জ্ঞান দান করা সম্পর্কে কোন অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়নি এখানে। দুই, এ আয়াতটি কিয়ামতের জ্ঞান দান করার আগেই নাযিলকৃত।
❏ তাফসীরে সাবীতে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছেঃ
وَالَّذِىْ يَجِبُ الْاِيْمَانُ بِهِ اَنَّ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَنْتَقِلْ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى اَعْلَمَُ ُاللهُ بِجَمِيْعِ الْمُغَيِّبَاتِ الَّتِىْ تَحْصُلُ فِى الدُّنْيَا وَالْاَخِرَةِ فَهُوَ
يَعْلَمُ هَا كَمَاهِىَ عَيْنَ يَقِيْنٍ لِّمَا وَرَدَ رُفِعَتْ لَى الدُّنْيَا فَاَنَا اَنْظُرُ فِيْهَا كَماَ اَنْظُرُ اِلَى كَفِّىْ هَذِهِ وَوَرَدَ اَنَّاهُ اُطُّلِعَ عَلَى الْجَنَّةِ وَمَا فِيْهَا وَالنَّارِ وَمَافِيْهَا وَغَيْرِ ذَلِكَ مِمَّا تَوَاتَرَتِ الْاَخْبَارُ وَلَكِن اُمِرَ بِكِتْمَانِ بَعْضِهَا
অর্থাৎ- এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি বিশ্বাস করা একান্ত দরকার, সেটা নবী আলাইহিস সালাম পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন নি, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআরা রাসূল (ﷺ) সে সমস্ত অদৃশ্য ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যা দুনিয়া ও আখিরাতে সংঘটিত হবে। তাঁর জ্ঞান একজন প্রত্যক্ষদর্শীয় জ্ঞাত তথ্যের মত। কেননা, হাদীছে বর্ণিত আছে- ‘আমার সামনে দুনিয়াকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি নিজের হস্তস্থিত বস্তু দেখার মত সবকিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করছিলাম। আরও বর্ণিত আছে যে, তাঁকে বেহেশ্ত ও সেখানকার যাতীয় নিয়মত, দেযাখ ও সেখানকার যাবতীয় শাস্তি ও যন্ত্রণা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত করা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কিত কিছু কিছু তথ্য তাঁকে গোপন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ২/৭৩৩ পৃ.}
তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে এ আয়াতটির আসল ইবারত হচ্ছে يَسْئَلُوْنَكَ عَنْهَا كَاَنَّكَ حَفِىٌُّ অর্থাৎ ওই সকল লোক আপনাকে এমনভাবে জিজ্ঞাসা করছে যেন আপনি তাদের প্রতি বড় মেহেরবান। আপনি তাদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করবেন। অথচ এটা খোদার ভেদসমূহের অন্যতম যা অপরের কাছে গোপন রাখা একান্ত দরকার। এতে বোঝা গেল যে রাসূল (ﷺ)-এর কিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞান আছে কিন্তু তা প্রকাশ করার অনুমতি নেই।
(১৫)يَسْئَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ قُلْ اِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللهِ
-‘‘লোকেরা আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। আপনি বলুন যে এ সম্পর্কে আল্লাহই জ্ঞাত।’’
{সূরাঃ আহযাব, আয়াতঃ ৬৩, পারাঃ ২২}
❏ তাফসীরে সাবীতে এ আয়াতের তাৎপর্য বিশেষণে লিখা হয়েছেঃ
اِنَّمَا هُوَوَقْتُ السُّوَالِ وَاِلاَّفَلَمْ يَخْرُجْ نَبِيُّنَا عَلَيْهِ السَّلاَمُ حَتَّى اَطْلَعَهُ اللهُ عَلَى جَمِيْعِ الْمَغْيِّبَاتِ وَمِنْ جُمْلَتِهَا السَّاعَةُ
-‘‘কিয়ামত সম্পর্কে কেউ সম্যকরূপে অবগত নয় কথাটি এ সম্পর্কে প্রশ্ন করার সময় প্রযোজ্য ছিল। কেননা নবী আলাইহিস সালাম দুনিয়া থেকে তশরীফ নিয়ে যান নি, যে পর্যন্ত না রাসূল (ﷺ)-কে আল্লাহ তা’আলা যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যার মধ্যে কিয়ামতও অন্তভুর্ক্ত।’’
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৪/২৮৯ পৃ.}
❏ এ আয়াত প্রসঙ্গে তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ আছেঃ
وَلَيْسَ مِنْ شَرْطِ النَّبِىِّ اِنْ يَّعْلَمَ الْغَيْبَ بِغَيْرِ تَعْلِيِمٍ مِّنَ اللهِ تَعَالى
অর্থাৎ- নবী হওয়ার শর্তাবলীর মধ্যে এরূপ কোন শর্ত নেই যে, আল্লাহ কর্তৃক জ্ঞাত করা ছাড়া অদৃশ্য বিষয়াদি জানতে হবে।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/২৮৮ পৃ.}
আয়াতে কাউকে কিয়ামতের জ্ঞান দান করা সম্বন্ধে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়নি। সুতরাং, রাসূল (ﷺ) এ সম্পর্কে অনবহিত একথাটি আলোচ্য আয়াত থেকে প্রমাণ গ্রহণই ভুল।
❏ তাফসীরে সা’বীতে اِلَيْهِ يُرَدُّ عِلْمُ السَّاعَةِ আয়াতটির ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
اَلْمَعْنِىْ لاَيُفِيْدُ عِلْمُهُ غَيْرُهُ تَعَالَى فَلاَيُنَافِىْ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَخْرُجْ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى اُطَّلِعَ عَلَى مَاكَانَ وَمَايَكُوْنُ وَمَا هُوَ كَائِنُ وَمِنْ جَمْلَتِهِ عِلْمُ السَّاعَةِ
অর্থাৎ- এর অর্থ হলো- কিয়ামতের জ্ঞান খোদা ছাড়া কেউ দিতে পারে না। সুতরাং, আয়াতটি ঐ বর্ণনার পরিপন্থী নয়, যেখানে বলা হয়েছে নবী আলাইহিস সালাম দুনিয়া থেকে তশরীফ নিয়ে যান নি, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ﷺ)-কে পূর্বাপর যাবতীয় ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। কিয়ামতের জ্ঞানও এগুলোর অন্তভুর্ক্ত।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৫/৫২ পৃ.}
বিরুদ্ধমতাবলম্বীগণ কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের অস্বীকৃতির সমর্থনে মিশকাত শরীফের শুরুতে সন্নিবেশিত এ রেওয়াতটি পেশ করেন;
❏ হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) একদা রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আরয করেছিলেন,
اَخْبِرْنِىْ عَنِ السَّاعَةِ
(আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে খবর দিন।)
❏তখন হুযুুর আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-
مَاالْمَسْئُوْلُ عَنْهَا بِاَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ
অর্থাৎ- এ প্রসঙ্গে আমি প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশী কিছু জানি না।
এ থেকে বোঝা গেল যে রাসূল (ﷺ) কিয়ামতের জ্ঞান নেই। কিন্তু এ দলীলটাও দ্বিবিধ কারণে একেবারে ভিত্তিহীন। এর একটি কারণ হলো এতে রাসূল (ﷺ) স্বীয় জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন নি। কেবল অপেক্ষাকৃত বেশী জ্ঞানের অস্বীকৃতির প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা নাহলে তিনি বলতেন لاَاَعْلَمُ (আমি জানি না)
এরূপ না বলে এত লম্বা চওড়া কথাই বা কেন বললেন? এর মূল বক্তব্য এও হতে পারে যে, হে জিব্রাইল, এ প্রসঙ্গে আমার ও আপনার জ্ঞান একই ধরনের। অর্থাৎ এ প্রসঙ্গে আমি যেরূপ অবগত আপনিও সেরূপ অবগত আছেন। কিন্তু এ জনসমক্ষে রহস্যের উদঘাটন সমীচীন নয়।
দ্বিতীয় কারণ, হলো উত্তর শুনে জিব্রাইল (عليه السلام) আরয করেছিলেন,
فَاَخْبِرْ عَنْ اَمَارَاتِهَا
(তা’হলে কিয়ামতের লক্ষণ সমূহ বলে দিন)।
এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল (ﷺ) কয়েকটি লক্ষণ বর্ণনা করলেন। যেমন সন্তান-সন্ততির অবাধ্য হওয়া, নীচু জাতের লোকদের পার্থিব সম্মানের অধিকারী হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। যার কিয়ামত সম্পর্কে কোন ধারণাই না থাকে তাঁর নিকট লক্ষণ জিজ্ঞাসা করার কীই বা তাৎপর্য হতে পারে। কোন কিছুর লক্ষণ বা খোঁজ জানতে হলে সে সম্পর্কে জ্ঞাত লোককেই তো জিজ্ঞাসা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, রাসূল (ﷺ) কিয়ামতের দিন সম্পর্কে বলে দিয়েছেন।
❏ মিশকাত শরীফের জুমা অধ্যায়ে উল্লেখিত আছেঃ
لاَتَقُوْمُ السَّاعَةُ اِلاَّفِىْ يَوْمِ الْجُمْعَةِ
(জুমার দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে)
{আবু দাউদঃ আস-সুনানঃ ১/২৭৪ হাদিস নং- ১০৪৬}
❏আঁক্বা হযরত (ﷺ) নিজ হাতের শাহাদত ও মধ্যমা আঙ্গুলীদ্বয় একত্রিত করে বলেছিলেন,
بُعِثْتَ اَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَا تَيْنِ
আমার এ ধরায় আগমন ও কিয়ামত এ দু’আঙ্গুলীর মত ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
{ক. বুখারীঃ আস-সহীহঃ কিতাবুর-রিককঃ ৫/২৩৮৫ হাদিসঃ ৬১৩৮-৬১৩৯
খ. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ বাবুল খুতবাতুল ইয়াওমাল জুমাঃ প্রথম পরিচ্ছেদঃ ১/১২৩ পৃ.}
অর্থাৎ আমার যুগের পরেই কিয়ামত অনুষ্ঠিতব্য।
(মিশকাত শরীফঃ খুতবায়ে ইয়াওমে জুমা শীর্ষক অধ্যায়)
রাসূল (ﷺ) কিয়ামতের সব লক্ষণই এমনভাবে নির্দেশ করেছেন যে একটি কথাও বাদ দেন নি। আজ আমি হলফ করে বলতে পারি যে কিয়ামত এক্ষুণি সংঘটিত হতে পারে না। কেননা এখনও দাজ্জাল আসেনি হযরত মসীহ (عليه السلام) ও মাহদী (عليه السلام) এর আবির্ভাব হয়নি। এবং সূর্যও পশ্চিম দিকে উদিত হয়নি। এসব লক্ষণ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সুনিশ্চিত ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট করে দিয়েছেন। এর পরও কিয়ামতের জ্ঞান না থাকার কি অর্থ হতে পার? শুধু এতটুকু বলা যায় যে সনের কথা উল্লেখ করেন নি। অর্থাৎ অমুক সনে কিয়ামত সংঘটিত হবে একথা বলেন নি। স্মর্তব্য যে রাসূল (ﷺ) এর যুগে সন প্রচলিত হয়নি। হিজরী সন হযরত উমর ফারুকের (رضي الله عنه) শাসনামলে প্রবর্তিত হয়। হিজরতের ঘটনা ঘটে রবিউল আউয়াল মাসে কিন্তু হিজরী সনের সূচনা হয় মহররম মাস থেকে। সে যুগে প্রচলিত নিয়ম ছিল যে কোন বৎসর বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলেই তার স্মৃতিবাহী রূপে উক্ত ঘটনার সঙ্গে সনকে সম্পৃক্ত করে দেয়া হতো। যেমন, হাতীর বছর, বিজয়ের বছর, হুদাইবিয়ার বছর ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট হিজরী সনের উল্লেখ আদ্যে সম্ভবপর ছিল কি? তাই ঐ দিনের যাতীয় লক্ষণ বলে দিয়েছেন। যে পবিত্র সত্ত্বা বিস্তারিতভাবে এতগুলো লক্ষণের বর্ণনা দিতে পারেন, তিনি কিভাবে সে বিষয়ে অজ্ঞ হতে পারেন? অধিকন্তু আমি ইলমে গায়বের সমর্থনে পূর্বে একটি হাদীছ পেশ করেছি, যেখানে উক্ত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) কিয়ামত অবধি যাবতীয় ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দিয়েছিলেন। এরপরেও কিয়ামত সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার কথা চিন্তা করার অবকাশ থাকতে পারে কি? দুনিয়ার সমাপ্তি ঘটার সাথে সাথেই তো কিয়ামত। আর রাসূল (ﷺ)-এর আরও জানা আছে যে যাবতীয় ঘটনাবলীর মধ্যে কোনটার পর কোনটা ঘটবে। যে সর্বশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন উহাই দুনিয়ার সমাপ্তি ও কিয়ামতের সূচনার সুস্পষ্ট দিক দর্শনরূপে প্রতিভাত হবে। দুটো পরস্পর মিলিত বস্তুর বা বিষয়ের একটির সমাপ্তির জ্ঞান অপরটির সূচনার জ্ঞান অবশ্যম্ভাবীরূপে জন্ম দেয়। এ ব্যাপারে খুব মনোযোগ সহকারে চিন্তা ভাবনা দরকার। একথাটি প্রণিধানযোগ্য অতিশয় তাৎপর্যমন্ডিত ও অনবদ্য, যা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও মুরশিদ,হযরত সদরুল আফাজেল মাওলানা সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী সাহেব (رحمة الله) তার এক ভাষণে বলেছিলেন।
(১৬)إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
-‘‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন তিনি জানেন মায়ের পেটে যা’ কিছু আছে, কেউ একথা জানে না যে কাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না যে কোন জায়গায় সে প্রাণ ত্যাগ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয় জ্ঞানী ও অবহিতকারী।’’
{সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ৩৪, পারাঃ ২১}
এ আয়াতকে সামনে রেখে ভিন্নমতাবলম্বীগণ বলেন যে উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নেই, এটি আল্লাহর গুণ। যে অপর কাউকে এগুলোর অধিকারী সাব্যস্ত করবে, সে মুশরিক বলে গণ হবে। কিয়ামত কখন হবে, বৃষ্টি কখন হবে, গর্ভবতী মহিলার গর্ভে ছেলে কি মেয়ে, আগামীকাল কি হবে এবং কে কোথায় মারা যাবে- এ পাঁচটি বিষয়ের জ্ঞানকে পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান (عُلُوْمِ خَمْسَه) নামে অভিহিত করা হয়।
❏ এ আয়াতের সমর্থনে তারা মিশকাত শরীফের শুরুতে উল্লেখিত রেওয়াতেটিও উপস্তাপন করেন, যেখানে বলা হয়েছে জিব্রাইল (عليه السلام) রাসূল (ﷺ)কে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনিই ইরশাদ করেছিলেনঃ
فِىْ خَمْسِ لاَ يَعْلَمُ هُنَّ اِلاَّ اللهُ ثُمَّ قَرَءَ اِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ
-‘‘ওই পাঁচটি বিষয় সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কেউ জানে না। এরপর রাসূল (ﷺ) উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।’’
আমি এ পঞ্চ জ্ঞান সম্পর্কে একান্ত ন্যায়ানুগ বিচার বিশেষণ করার প্রয়াস পাচ্ছি এবং সুধি পাঠকবৃন্দের ন্যায় সঙ্গত বাচ-বিচার ও মহান আল্লাহর নিকট এ আলোচনাটুকু গৃহীত হওয়ার আশা রাখি। আমি প্রথমে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরকারকদের উক্তি, এরপর উক্ত হাদীছ প্রসঙ্গে সর্বজনমান্য মুহাদ্দিছগণের মন্তব্য ও সর্বশেষে আমার নিজের যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য পেশ করছি।
❏ তাফসীরাতে আহমদীয়ায় উক্ত আয়াতের ব্যা্যখায় উলিখিত আছেঃ
وَلَكَ اَنْ تَقُوْلَ اِنَّ عِلْمَ هَذِهِ الْخَمْسَةِ لاَ يَعْلَمُهَا اَحَدٌُ اِلاَّ اللهُ لَكِنْ يَّجُوْزَ اَنْ يَّعْلَمُهََا مَنْ يَّشَاءُ مِنْ مُحِبِّيْهِ وَاَوْ لِيَاءِ ه بِقَرِيْنَةِ قَوْلِهِ تَعَالَى اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌُ خَبِيْرٌُ بَمَعْنِى الْمُخْبِرِ
-‘‘আপনি এ কথাও বলতে পারেন যে, এ পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে খোদা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। কিন্তু এও সঙ্গতঃ যে আল্লাহ তা’আলা তার ওলী ও প্রিয়জনদের মধ্যে যাকে/ যাদেরকে ইচ্ছে এ সমস্ত বিষয়ে অবহিত করেন। আয়াতের মধ্যেই এ কথার প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ আয়াতে উক্ত হয়েছে- (اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌُ خَبِيْرٌُ) আল্লাহ জ্ঞানী ও অবহিতকারী এ খরীরুন خَبِيْرٌُ শব্দটি মুখবিরুন مُخْبِرٌُ অবহিতকারী অর্থেই প্রয়োগ করা হয়েছে।’’
{আল্লামা মোল্লা জিওনঃ তাফসীরে আহমদিয়াঃ পৃ. ৬০৮}
❏ তাফসীরে সাবীতে আয়াতাংশ
{সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ৩৪, পারাঃ ২১}
مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে
اَىْ مِنْ حَيْثُ ذَا تِهَا وَاَمَّا بِاِ عْلاَمِ اللهِ لِلْعَبْدِ فَلاَ مَانِعَ مِنْهُ كَالْاَنْبِيَاءِ وَبَعْضِ اَلاَوْ لِيَاءِ قَالَ تَعَالى وَلاَيُحِيْطُوْنَ بِشَيْئٍ مِنْ عِلْمِهِ اِلاَّ بِمَا شَاءُ قَالَ تَعَالَى فَلاَيُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ اَحَدًا اِلاَّ مَنِ اَرْتَضَى مِنْ رَّسُوْلٍ فَلاَ مَانِعَ مِنْ كَوْنِ اللهِ يُطْلِعُ بَعْضَ عِبَادِهِ الصَّلِحِيْنَ عَلَى بَعْضِ الْمُغَيِّبَاتِ فَتَكُوْنُ مُعْجِزَةً لِلنَّبِىِّ وَكَرَ امَةً لِلِوَلِىِّ وَلِذَالِكَ قَالَ الْعَلَمَاءُ الْحَقُّ اَنَّهُ لَمْ يَخْرُجْ نَبِيًُّنَا مِنَ الدُّنْيَا حَتَى اَطْلَعُهُ عُلَى تِلْكَ الْخَمْسِ
অর্থাৎ ওই সব বিষয় কেউ সত্ত্বাগতভাবে জ্ঞাত নয়, কিন্তু আল্লাহ কর্তৃক অবহিত করার ফল শ্রুতিতে জানার ব্যাপারে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা নেই। যেমন নবীগণ ও মুষ্টিমেয় ওলীগণ সে সমস্ত বিষয় জ্ঞাত হন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন- এসব লোক আল্লাহর জ্ঞানকে আয়ত্ত্ব করতে পারেন না, তবে যতটুকু আল্লাহ চান, ততটুকু পারেন। আরও ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ তার মনোনীত রাসূলগণ ছাড়া অন্য কারো নিকট তার রহস্যাবলী ও অদৃশ্য বিষয়াদি উন্মোচন করেন না। সুতরাং, আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক তার কোন প্রিয় বান্দাকে কোন কোন অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করার ব্যাপারে কোনরূপ অন্তরায় নেই। অতএব জ্ঞানের প্রকাশ নবীর “মুজিযাও ওলীর ‘কারামত’ হিসাবে গণ্য হবে। এজন্য সুবিজ্ঞ আলিমগণ বলেন যে, সঠিক কথা হচ্ছে রাসূল (ﷺ) ইহজগত থেকে তাশরীফ নিয়ে যান নি, যতক্ষণ না পঞ্চবিষয়ে তাকে অবহিত করা হয়েছে।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৩/২৬০ পৃ.}
❏ তাফছিরে আরাঈসুল বয়ানে আয়াতাংশ
{সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ৩৪, পারাঃ ২১}
يَعْلَمُ مَا فِى الْاَرْحَامِ এর তাৎপর্য বিশেষণ প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছেঃ
سَمِعْتُ اَيْضًا مِنْ بَعْضِ الْاَوْلِيَاءِ اَنَّهُ اَخْبَرَ مَا فِي الرَّحْمِ مِنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثَى وَرَئَيْتُ بِعَيْنِىْ مَااَخْبَرَ
-‘‘কোন কোন ওলীর কাছে শুনেছি যে তাঁরা গর্ভস্থিত শিশু ছেলে কি মেয়ে সে সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে আগে ভাগেই বলে দিয়েছেন এবং আমি নিজের চোখে দেখেছি যে তারা যা বলেছেন তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি।’’
❏ ‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা আছেঃ
وَمَا رُوِىَ عَنِ الْاَنْبِيَا ءِ وَالْاَوْلِيَاءِ مِنَ الْاَخْبَارِ عَنِ الْغُيُوْبِ ِفَبِتَعْلِيْمِ اللهِ تَعَالْىَ اِمَّا بِطَرِيْقِ الْوَحِىْ اَوْ بِطَرِيْقِ اَلْاِلْهَاَمِ وَالْكَشْفِ وَكَذَا اَخْبَرَ بَعْضُ الْاَوْلِيَاءِ عَنْ نُزُوْلِ الْمَطْرِ وَاَخْبَرَ عَمَّافِيْ الَّرحْمِ مِنْ ذَكَرٍاَ وَّاُنْثَى فَوَقَعَ كَمَا اَخْبَرَ
-‘‘নবী ও ওলীগণ থেকে যে সব অদৃশ্য বিষয়াদির খবর আছে, সেগুলো খোদা কর্তৃক অবহিত করার ফলশ্রুতি স্বরূপ তথা ওহী ‘ইলহাম’ বা ‘কাশ্ফের’ মাধ্যমে তারা জ্ঞাত হন। যেমন- কোন কোন ওলী বৃষ্টি বর্ষণ সম্পর্কে পূর্বেই বলে দিয়েছেন। তারা যে রকম বলেছেন ঠিক সে রকমই হয়েছে।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/১০৫ পৃ.}
কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞানের পর্যালোচনা আমি ইতিপূর্বেই করেছি উহাও পঞ্চ জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত।
উপরোক্ত তাফসীর সমূহের ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় হাবীব আলাইহিস সালামকে পঞ্চ জ্ঞান দান করেছেন এবং এ আয়াতে খবীর خَبِيْرٌُ শব্দটি মুখবির مُخْبِرٌُ অর্থাৎ অবহিতকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও অনেক তাফসীরের উদ্ধৃতি পেশ করা যেতে পারে। কিন্তু আলোচনা আর দীর্ঘায়িত না করে এখানেই শেষ করলাম। এখন বাকী রইল মিশকাত শরীফের কিতাবুল ঈমানের শুরুতে উল্লেখিত হাদীছটির প্রসঙ্গ, যেখানে বলা হয়েছে ওই পাঁচটির বিষয় সম্পর্কে কেউ জানে না। এখন উক্ত হাদীছের বিবিধ ভাষ্যের দিকে নজর দিন।
❏ ইমাম কুরতুবী (رحمة الله),
{ইমাম কুরতুবীর বক্তব্যটি হলো- وَقَالَ الْقُرْطُبِيُّ: مَنِ ادَّعَى عِلْمَ شَيْءٍ مِنْهَا غَيْرَ مُسْتَنِدٍ إِلَيْهِ - عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ - كَانَ كَاذِبًا فِي دَعْوَاهُ. -ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) বলেন, সে মিথ্যুক বলে বিবেচিত যে বলবে হুযুর (ﷺ) কোন মাধ্যম ছাড়া পঞ্চ বিষয়ের ব্যাপারে জানেন। (সুত্রঃ মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ১/৬৬পৃ. হাদিসঃ ৩ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪২২হি.) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ওলীরাও জানেন কাশ্ফের মাধ্যমে সে প্রসঙ্গে বলেন- وَمَا ذَكَرَهُ بَعْضُ الْأَوْلِيَاءِ مِنْ بَابِ الْكَرَامَةِ بِأَخْبَارِ بَعْضِ الْجُزْئِيَّاتِ مِنْ مَضْمُونِ كُلِّيَّاتِ الْآيَةِ، فَلَعَلَّهُ بِطَرِيقِ الْمُكَاشَفَةِ أَوِ الْإِلْهَامِ أَوِ الْمَنَامِ الَّتِي هِيَ ظَنِّيَّاتٌ لَا تُسَمَّى عُلُومًا يَقِينَيَّاتٍ، - (মেরকাত, প্রাগুক্ত)‘‘}
❏ইমাম আইনী (رحمة الله) ও ইমাম কুস্তালানী (رحمة الله) বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ এবং মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাতের কিতাবুল ঈমানের ১ম পরিচ্ছেদ ঐ হাদীছের প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করেছেনঃ
فَمَنِ ادَّ عَى عِلْمَ شَيْئٍ مِنْهَا غَيْرَ مُسْنَدٍ اِلَى رَسُولِ للهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ كَاذِ بًافِىْ دُّعْوَاهُ
-‘‘সুতরাং, যে কেউ রাসূল (ﷺ)-এর মাধ্যম ছাড়া এ পঞ্চ বিষয়ের যে কোন একটি বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবী করে সে স্বীয় দাবীতে মিথ্যুক।’’
{ক. আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীঃ উমদাদুল ক্বারীঃ কিতাবুল ঈমানঃ ১/২৯০ পৃ.
খ. আল্লামা ইমাম কুস্তালানীঃ ইরসাদুস সারীঃ কিতাবুল ঈমানঃ ১/১৪১ পৃ.
গ. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীঃ ফতহুল বারীঃ কিতাবুল ঈমানঃ ১/১২৪ পৃ.
ঘ. মোল্লা আলী ক্বারীঃ মিরকাতঃ ১/৬৫ পৃ.
ঙ. আল্লামা আলূসী বাগদাদীঃ তাফসীরে রুহুল মায়ানীঃ ২১/১১২ পৃ.}
❏ ‘আশিয়াতুল লুম‘আত’ গ্রন্থে শায়খ আব্দুল হক (رحمة الله) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,
المراد لا يعلم يدون تعليم الله
অর্থাৎ- ইহার দ্বারা উদ্দেশ্য এই পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান এক আল্লাহ তা’য়ালা জানানো বা শিক্ষা ছাড়া কেউ জানতে পারে না।
{ক. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ লুমআতঃ ৩/৭৩ পৃ.}
তিনি একটু অগ্রসর হয়ে বলেন-
مراد آنست كه بے تعليم الهى بحساب عقل اينها راندانداز امور غيب اند كه جز خداے تعا لى كے اں اند اند مگر انكه وى تعالى ازنزد خود كے رابوحى والهام بداناند
অর্থাৎ হাদীছের ভাবার্থ হলো এসব অদৃশ্য বিষয়ে আল্লাহ কর্তৃক অবহিত করা ছাড়া কেউ স্বীয় প্রজ্ঞা ও সহজাত জ্ঞানের বলে জ্ঞাত হতে পারে না। কেননা সেগুলো সম্পর্কে খোদা ব্যতীত আর কেউ জ্ঞাত নয়, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা যাকে ওহী কিংবা ইলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দেন তিনিই জ্ঞাত হন।
{আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীঃ আশিয়াতুল লুমআতঃ ১/৪৪ পৃ.}
❏ ইমাম কুস্তালানী (رحمة الله) শরহে বুখারীর কিতাবুত তাফসীর সুরা ‘রা’দে উল্লেখ করেছেনঃ
لاَيَعْلَمُ مَتَى تَقُوْمُ الْسَّاعَةُ اِلاَّ اللهُ وَاِلاَّ مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَّسُوْلِ فَاِنَّهُ يُطْلِعُهُ عَلَى غَيْبِهِ وَالْوَلِىُّ التَّابِعُ لَهُ يَا خُذُهُ عَنْهُ
অর্থাৎ- কিয়ামত কখন হবে এ সম্পর্কে আল্লাহ ও তার মনোনীত রাসূল ছাড়া আর কেউ জানে না। কেননা মহাপ্রভু আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূলকে তাঁর গোপন রহস্যাবলী সম্পর্কে অবহিত করেন। সেই রাসূলের অনুসারী ওলী তাঁর (রাসূল)-এর নিকট থেকে সে জ্ঞান লাভ করেন।
{আল্লামা ইমাম কুস্তালানীঃ ইরশাদুস সারীঃ ৭/১৮৬ পৃ.}
انجاح لحاجه حاشيه ابن ما جه নামক গ্রন্থের اشراط الساعة শীর্ষক অধ্যায়ে এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছেঃ
اَخْبَرَ الصِّدِّيْقُ زَوْجَتَهُ بِنْتَ خَارِجَةَ اَنَّهَا حَامِلَةُ بِنْتٍ فَوَلَدَتْ بَعْدَ وَفَاتِهِ اُمٌُ كُلْثُوْمِ بِنْتِ اَبِىْ بَكْرٍ فَهَذَا مِنَ الْفَرَاسَةِ وَالظَّنِّ وَيُصَدِّقُ اللهُ فُرَاسَةَ الْمُؤْ مِنِ
অর্থাৎ- হযরত সিদ্দীক আকবর (رضي الله عنه) নিজের স্ত্রী বিনতে হারিজাকে বলেছিলেন যে তিনি কন্যা সন্তান গর্ভধারণ করেছে। সিদ্দীক আকবেরর ওফাতের পর উম্মে কুলসুম বিনতে সিদ্দীক জন্মগ্রহণ করেন। এ খবরটি ছিল তার দিব্য জ্ঞান ও ধারণা প্রসূত। আল্লাহ তা’আলা মুমিনের দিব্য ধারণাকে সত্যে পরিণত করেন।
{হাশীয়ায়ে ইবনে মাযাহঃ ২৯৩, কাদীমী কুতুবখানা, করাচী, পাকিস্তান।}
━━━━━━━━━━━━━━━━
❏ সৈয়দ শরীফ আবদুল আযীয মাসউদ كتاب الابريز নামক গ্রন্থে বলেছেন-
هُوَعَلَيْهِ السَّلاَمُ لاَيَخْفَى عَلَيْهِ مِنْ شَئٌُ مِنَ الْخَمْسِ الْمَذْكُوْرَةِ فِى الْاَيَةِ وَكَيْفَ يَخْفَى ذَالِكَ وَالْاَقْطَابُ السَّبْعَةُ مِنْ اُمَّتِهِ الشَّرِ يْفَةِ يَعْلَمُوْنَهَا وَهُمْ دُوْنَ الْغَوْثِ فَكَيْفَ بِالْغَوْثِ فَكَيْفَ بِسَيِّدِ الِاَوَّلِيْنَ وَالْاَخِرِيْنَ الَّذِىْ هُوَسَبَبُ كُلِّ شَئْيٍّ مِنْهُ كُلُّ شَيئٌُ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ)-এর নিকট উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের কোনটিই গোপন নয়। এসব বিষয় তার সুদূর প্রসারী দৃষ্টি এড়াতে পারে কিভাবে? যেখানে রাসূল (ﷺ) উম্মতের সাতজন কুতুবও এগুলো সম্বন্ধে অবগত। তাঁরা তো গাউছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে অধিষ্ঠিত। এখন গাউছের জ্ঞান সম্পর্কে কি বলা হবে? আর যিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল জ্ঞানী গুণীদের সরদার, যিনি সমস্ত কিছুর মূল এবং যার থেকে সবকিছুই বিকশিত সে পবিত্র সত্ত্বার জ্ঞান সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করবেন?
{সৈয়দ শরীফ আব্দুল আযীয মাসউদঃ কিতাবুল ইবরিযঃ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ ১৬৭-১৬৮ পৃ.}
❏ আল্লাহ জালাল উদ্দীন সুয়ুতী (رحمة الله)-এর জামে সগীরের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘রাওয়াযুন নযীরে’ এ হাদীছ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
قَوْلُهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اِلاَّهُوَ مَعْنَاهُ بِاَنَّهُ لاَيَعْلَمُهَا اَحَدٌُ بِذَاتِهِ اِلاَّهُوَ لكِنْ قَدْ يَعْلَمُ بِهِ بِاِعْلاَمِ اللهِ فَاِنَّ ثَمَّ مَنْ يَعْلَمُهَا وَقَدْ وَجَدْ نَا ذَالِكَ بِغَيْرِ وَاحِدٍ كَمَا رَءيْنَا جَمَا عَةً عَلِمُوْا مَتَى يَمُوْتُوْنَ وَعَلِمَوْا مَافِى الْاَرْحَامِ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ)-এর اِلاَّهُوَ বলার অর্থ হচ্ছে যে, সে সমস্ত বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া সত্ত্বাগতভাবে আর কেউ জ্ঞাত নয় তবে কখনো আল্লাহ কর্তৃক অবহিত করার ফলে জ্ঞাত হওয়া যায়। কেননা এখানে এমন বুযুর্গলোক আছেন যারা এগুলো সম্পর্কেও জানেন। এ ধরনের অনেক ব্যক্তি আমি দেখেছি। যেমন- আমি এমন এক সম্প্রদায়কে দেখেছি, যাঁরা জানতেন, কখন তাঁরা ইনতিকাল করবেন। এমনিভাবে তারা গর্ভস্থিত শিশু সম্পর্কে জানতেন।
{ইমাম আহমদ রেযা খানঃ খালিসুল ই’তিকাদঃ পৃ. ৭২}
❏ আল্লামা জালালউদ্দীন সুয়ুতী (رحمة الله) “খাসায়েসুল কোবরা” শরীফে উল্লেখ করেছেনঃ
عَرِضَ عَلَيْهِ مَا هُوَ كَائِنٌُ فِيْ اَُمَّتِهِ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ)-এর নিকট সে সমস্ত বিষয় বা ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে, যা রাসূল (ﷺ)-এর উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত ঘটতে থাকবে।
❏ আল্লামা ইব্রাহিম বাইজুরী (رحمة الله) শরহে কাসীদায়ে বুর্দ্দার ৭৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ
لَمْ يَخْرُجِ النَّبِىُّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِنَ الدُّنْيَا اِلاَّبَعْدَ اَنْ اَعْلَمَهُ اللهُ بِهَذِهِ اَلاُمُوْرِ الْخَمْسَّةِ
অর্থাৎ- রাসূল (ﷺ) ধরাপৃষ্ঠ থেকে তশরীফ নিয়ে যাননি, যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলা তাঁকে (ﷺ) পঞ্চ বিষয়ের عَلُوْمِ خَمْسَةِ জ্ঞান দান করেন।
❏ জামেউন নিহায়া جمع النهاية গ্রন্থে আল্লামা শুনওয়ারী (رحمة الله) বলেছেনঃ
وَقَدْ وَرَدَاَنَّ اللهُ تَعَالَى لَمْ يُخْرِجِ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حَتَّى اَطْلَعَهُ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيئٍ
অর্থাৎ- একথা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, আল্লাহ তা’আলা নবী আলাইহিস সালামকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাননি, যতক্ষণ না প্রত্যেক বিষয় সম্বন্ধে তাঁকে অবহিত করেন।
{ইমাম আহমদ রেযা খানঃ খালিসুল ই’তিকাদঃ পৃ. ৭৭-৭৮}
❏ আল্লামা শুনওয়ারী (رحمة الله) একই কিতাবে আরও বলেন-
قَالَ بَعْضَ الْمُفَسِّرِيْنَ لاَيَعْلَمُ هَذِهِ الْخَمْسَ عِلْمًا لِدُّنْيًا ذَاتِيًا بِلاَّ وَاسِطَةٍ اِلاَّ اللهُ فَاْلِعْلُم بِهَذِهِ الصَّفَةِ مِمَّا اخْتَصَّ للهُ بِهِ وَاَمَّا بِوَاسِطَهٍ فَلاَ يَحْتَصُّ بِهِ
অর্থাৎ- কোন কোন তাফসীরকারক বলেন যে, উক্ত পঞ্চ বিষয় علوم خمسة সম্পর্কে সত্ত্বাগত ও মাধ্যম বিহীন একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ অবহিত নয়। এ রকম জ্ঞাত হওয়ার ব্যাপারটি কেবল আল্লাহর জন্য সীমিত। কিন্তু কোন মাধ্যমসূত্রে লব্ধ জ্ঞান আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নয়।
{ইমাম আহমদ রেযা খানঃ খালিসুল ই’তিকাদঃ পৃ. ৭৭-৭৯}
❏ ‘আরবায়ীনে ইমাম নববী (رحمة الله) এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফুতুহাতে ওয়াহবিয়া’তে ফাযিল ইবন ‘আতিয়ায় বলেছেনঃ
اَلْحَقُّ كَمَا قَالَ جَمْعٌُ اَنَّ اللهَ لَمْ يَقْبِضَ نَبِيِّنَا عَلَيْهِ السَّلاَمُ حَتَّى اَطْلَعَهُ عَلَى كُلِّ مَا اَبْهَمَ عَنْهُ اِلاَّ اَنَّهُ مِرَ بِكَتِمَ بَعْضٍ وَالْاِعْلاَمِ بِبَعْضٍ
অর্থাৎ- সঠিক কথা হলো, যা দ্বীনী মনীষীদের এক সম্প্রদায় বলেছেন আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ﷺ)কে, এ ধরাধাম থেকে নিয়ে যান নি, যতক্ষণ না যাবতীয় গুপ্ত ও রহস্যাবৃত বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন। অবশ্য কোন কোন তথ্য গোপন রাখার ও কোন কোনটি ব্যক্ত করার জন্য তিনি আদিষ্ট ছিলেন।
❏ আল্লামা শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী সাহেব (رحمة الله) ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন’ নামক গ্রন্থের ১১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ
نقل مي كند كه والد شيخ ابن حجر رافر زند نمى زيست كبيده خاطر بحضور شيخ رسيد – شيخ فرمود كه از پشت تو فرزندے خواهد آمد كه بعلم خوددنيا راپر كند
অর্থাৎ- বর্ণিত আছে যে, শাইখ ইবন হাজর (রহমতুল্লাহে আনহু) এর পিতার কোন সন্তান বাঁচতো না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্বীয় শাইখ সাহেব (رحمة الله) এর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তাঁর শাইখ বললেন, ‘তোমার ঔরস থেকে এমন একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, যাঁর জ্ঞানালোক সারা দুনিয়া উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
{শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন (ফার্সী)- ৩০৪ পৃ. করাচী হতে মুদ্রিত।}
এতক্ষণ পর্যন্ত পঞ্চ জ্ঞানের علم خمسه সমর্থনে ঐতিহ্যগত বা কুরআন হাদীছে রিওয়ায়েতকৃত প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হলো। এর যুক্তি ও জ্ঞান ভিত্তিক প্রমাণ (আকলী-দলীল) হচ্ছে, ভিন্নমতাবলম্বীগণও একথা স্বীকার করেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টিকূলের থেকে অনেক বেশী। এ তথ্যের উদ্ধৃতি ইতিপূর্বে তাদের রচিত ‘তাহযীরুন্নাস’ নামক গ্রন্থ থেকে পেশ করেছি। এখন দেখতে হবে সৃষ্টিকূলের কাউকে উক্ত পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান দান করা হয়েছে কিনা।
❏ মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুল ঈমান বিল কদর’ এ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছেঃ রাসূল (ﷺ) মায়ের গর্ভে শিশুর শারীরিক গঠন প্রণালীর বর্ণনা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেনঃ
ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ إِلَيْهِ مَلَكًا بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ: فَيَكْتُبُ عَمَلَهُ، وَأَجَلَهُ، وَرِزْقَهُ، وَشَقِيٌّ، أَوْ سَعِيدٌ، ثُمَّ يَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ
-‘‘অতঃপর মহাপ্রতিপালক চারটি বিষয় সহকারে একজন ফিরিশতা প্রেরণ করেন। তিনি সে শিশুর আমল, মৃত্যু, জীবিকা এবং সে সন্তান নেককার হবে, না বদকার হবে এ চারটি বিষয় লিখে যান। এরপর ‘রূহ’ ফুঁকে দেওয়া হয়।’’
{ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ১/৩৬ পৃ. হাদিসঃ ৮২
খ. বুখারীঃ আস-সহীহঃ ৬/৩০৩ পৃ. হাদিসঃ ৩২০৮
গ. মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ৪/২০৩৬ হাদিসঃ ১
ঘ. আবু দাউদঃ আস-সুনানঃ ৫/৮২ পৃ. াহদিসঃ ৪৭০৮
ঙ. তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ ৪/৩৮৮ পৃ. হাদিসঃ ২১৩৭
চ. ইবনে মাজাহঃ আস-সুনানঃ আল-মুকাদ্দিসঃ ১/২৯ পৃ. হাদিসঃ ৭৬}
এগুলোও হচ্ছে পঞ্চ জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত। তাহলে বলতে হয়, বর্তমান ও বিগত সকল মানুষের এ চারটি বিষয়ে ভাগ্য লিপির লেখক ফিরিশতাও জ্ঞাত।
❏ মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছেঃ
كَتَبَ اللَّهُ مقادير الْخَلَائق قبل أَن يخلق السَّمَوَات وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ
-‘‘আল্লাহ তা’আলা আসমান ও যমীন সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই সৃষ্টিকূরের নিয়তি বা তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন।’’
{ ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ১/৩৬ হাদিসঃ ৭৯
খ. আল্লামা আজলুনীঃ কাশফুল খাফাঃ১/২৩৬, হাদিসঃ৭৬
গ. মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ৪/২০৪৪ হাদিসঃ ১৬}
বোঝা গেল যে, লওহে মাহফুজে উক্ত পঞ্চ বিষয়ের কথা লিপিবদ্ধ আছে। তা’হলে লওহে মাহফুজের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাগণ এবং অনুরূপ নবীগণ, এমন কি ওলীগণও যাদের দৃষ্টি লওহে মাহফুজের দিকে নিবদ্ধ থাকে, এ পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। মিশকাত শরীফের উক্ত ‘কিতাবুল ঈমান বিল কদর’ এ উল্লেখিত আছে যে, আল্লাহ কর্তৃক তার প্রভুত্বের স্বীকৃতি সূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণের দিন يوم ميثاق হযরত আদম (عليه السلام) কে তাঁর সমস্ত আওলাদের রূহ গুলো সাদা-কালো বর্ণে দেখানো হয়েছিল। কালো রূহগুলো ছিল কাফিরদের, আর সাদাগুলো মুসলমানদের। মি’রাজের সময় রাসূল (ﷺ) হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে এমন এক অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন, যখন তাঁর ডান দিকে সাদা এবং বাম দিকে কালো বর্ণের রূহসমূহ বিরাজমান ছিল। অর্থাৎ বেহেশতী ও দোযখী লোকগণ তাঁর যথাকব্রমে ডান ও বাম পাশের্ব বিরাজমান ছিল। মুমিনদেরকে দেখে তিনি আনন্দিত, আর কাফিরদেরকে দেখে দুঃখিত হতেন। এ মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুল ঈমান বিল কদর’-এ আরও উল্লেখিত আছে যে, একদিন রাসূল (ﷺ) নিজের দু’হাতে দু’টো কিতাব নিয়ে সাহাবীদের সমাবেশে আগমন করেন। ডান হাতস্থিত কিতাব সম্পর্কে বলেন- এতে বেহেশতীগণের না, তাঁদের নিজ নিজ গোত্রের নাম সহ উল্লেখিত আছে, এবং অপর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে- সমস্ত দোযখবাসীর নাম, তাদের নিজ নিজ গোত্রের নামসহ। পরিশেষে সে সমস্ত নামের মোট সংখ্যা কত হবে, তার যোগফলও দেয়া হয়েছে।
❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা ‘আলী কারী (رحمة الله) মিরকাত’ গ্রন্থে বলেছেনঃ
اَلظَّاهِرُ مِنَ الْاِ شَارَةِ اَنَّهُمَا حِسِّيَانِ وَقِيْلَ تَمْثِيْلٌُ
-‘‘হাদীছে ব্যবহৃত নির্দেশসূচক সর্বনাম (এ কিতাবটি) থেকে একথাই বোঝা যায় যে, ওই কিতাবগুলো দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।’’
{আল্লামা মোল্লা আলী ক্কারীঃ মিরকাতঃ ১/২৪২ পৃ. হাদিসঃ ৭৯}
❏ মিশকাত শরীফের ‘কবরের আযাব’ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, মৃত ব্যক্তি যখন মুনকীর নকীর ফিরিশতাদ্বয়ের পরীক্ষায় কৃতকার্য বা অকৃতকার্য হয়, তখন ফিরিশতাদ্বয় বলেনঃ
قَدْ كُنَّا نَعْلَمُ اَنَّكَ تَقُوْلُ هَذَا.
অর্থাৎ- আমরা আগেই জানতাম যে, তুমি এ রকম উত্তর প্রদান করবে।
{ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ১৪৬ হাদিসঃ ১৩০ হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর সূত্রে
খ. ইমাম তিরমিজীঃ ৩/৩৮৩ হাদিসঃ ২০৭১ হাসান সনদ}
বোঝা গেল যে, মৃত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করার পূর্বে উক্ত ফিরিশতাদ্বয় তার ‘নেককার’ ও ‘বদকার’ হওয়া সম্পর্কে জ্ঞাত হন। পরীক্ষাটা নিছক কানুনের অনুসরণ বা কেউ যাতে তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে মর্মে আপত্তি করতে না পারে, সে জন্য করা হয়ে থাকে। হাদীছ শরীফে আছে যে, কোন নেককার বান্দার সঙ্গে তার স্ত্রী দুনিয়াতে ঝগড়াঝাটি করলে, বেহেশত থেকে হুর ডাক দিয়ে বলেন, “সে তোমার কাছে কয়েক দিনের মেহমান মাত্র। শীগগির সে আমাদের কাছে ফিরে আসবে। তাই তাঁর সাথে ঝগড়া করো না।” (মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুন নিকাহ ফি ইশরাতিন নিসা” দ্রষ্টব্য) উপরোক্ত হাদীছ থেকে বুঝা গেল যে, ‘হুর’ ও একথা জানতে পারে যে, সে ব্যক্তির পরিণাম ভালই হবে। রাসূল (ﷺ) বদর যুদ্ধের একদিন আগে যমীনের উপর রেখা অংকিত করে বলেন, এখানে অমুক কাফির, ওখানে অমুক কাফির মারা যাবে।
(মিশকাত শরীফের কিতাবুল জিহাদ দ্রষ্টব্য)
এতে বোঝা যায় যে, রাসূল (ﷺ) ওদের মৃত্যুবরণের সুনির্দিষ্ট স্থান সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন।
উল্লেখিত হাদীছসমূহ থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর কতেক প্রিয় বান্দাগণকেও উক্ত পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন। আর রাসূল (ﷺ)-এর ব্যাপক জ্ঞান তাঁদের সবার সমষ্টিগত জ্ঞানের পরিধিেিকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। এমতাবস্থায় এটা কিভাবে সম্ভব যে রাসূল (ﷺ) পঞ্চ জ্ঞানের অধিকারী হবেন না? এ থেকে এও প্রমাণিত হলো যে, পঞ্চ জ্ঞান খোদা প্রদত্ত ও অচিরন্তন হওয়ার কারণে আল্লাহর গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। অন্যথায়, কেউ এ জ্ঞানের বিন্দুমাত্রও অধিকারী হতো না। কেননা, আল্লাহ তা’আলা কোন গুণে আংশিক বা সামগ্রিকরূপে কারও শরীক হওয়া বৈধ হতে পারে না। এ সব দলীলের উত্তর প্রদান বিরোধী মতাবলম্বীদের পক্ষে ইনশা আল্লাহ সম্ভবপর হবে না।
(১৭)وَمَا يَعْلَمُ تَاوِيْلَهُ اِلاَّاللهُ
অর্থাৎ- কুরআনের বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াতের (মুতশাবিহাত আয়াতের) মর্ম আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কেউ জানে না।”
{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ৩}
এ থেকে বোঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ)-এর ‘মুতশাবিহাত’ আয়াতের লক্ষ্যার্থের জ্ঞান ছিল না।
উত্তরঃ এ আয়াতে এ কথা কোথায় বলা হলো যে, আমি (আল্লাহ) ‘মুতশাবিহাত আয়াতের’ জ্ঞান কাউকে প্রদান করিনি? মহাপ্রভু তো ইরশাদ করেছেন- اَلرَّحْمَنُ – عَلَّمَ الْقُرْاَنَ [দয়াবান আল্লাহ (নিজের প্রিয় বন্ধুকে) কুরআন শিখিয়েছেন।] যখন মহাপ্রভুই সমগ্র কুরআন হুযুরকে শিখিয়েছেন তখন মুতশাবিহাত আয়াতও নিশ্চয়ই শিখিয়েছিলেন এজন্য হানাফী মাযহাবের সর্বসম্মত ‘আকীদা’ হলো রাসূল (ﷺ) মুতশাবিহাত সম্বন্ধে সম্যকরূপে জ্ঞাত, অন্যথায় সেগুলো নাযিল করাটাই অনর্থক হবে। শাফিঈ মাযহাবালম্বীদের মতে বিজ্ঞ আলিমগণও মুতশাবিহাত আয়াত সমূহের জ্ঞান রাখেন। তাঁরা আয়াত এর وَالرَّ اسِخُوْنَ فِى الْعِلْمِ, পরেই বিরাম চিহ্ন তথা ‘ওয়াক্ফ’ আছে বলে মত পোষন করেন এবং উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেন- মুতশাবিহার জ্ঞান আল্লাহ তা’আলা ও বিজ্ঞ উলামা ছাড়া আর কেউ জানে না।
(এ ব্যাপারে নুরুল আনওয়ারের মুতাশা বিহাত অধ্যায় দেখুন- বাহাদুর)
No comments