ইলমে গায়েবের সূক্ষ্ম রহস্যঃ
❏সূক্ষ্ম রহস্যঃ
জনৈক ভদ্রলোক আমাকে বলেছেন যে, আ’লা হযরত (কুঃ সিঃ) এখানে একটা রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। সেটা হলো এ আয়াতে আছে عِنْدَهَ مَفَاتِحَ الْغَيْبِ অন্যত্র আছে لَهُ مَقَاليْدُ السَّمَوَاتِ وَالْاَرْضِ মাফাতিহ ও মাকালীদ’ (مقاليد ও مفاتح) শব্দদ্বয়ের অর্থ হচ্ছে চাবিসমূহ। যদি مفاتح শব্দটির প্রথম ও শেষ অক্ষর। (م ও ح) এবং مقاليد শব্দটির প্রথম ও শেষ অক্ষর م ও د একত্রিত করা হয় তখন (محمد) শব্দ গঠিত হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ আলাইহিস সালামের সত্ত্বা হলো নিখিল বিশ্ব বিকাশের চাবিকাঠি। لاَيَعْلَمُهَا اِلاَّهُوَ (ঐগুলো সম্পর্কে তিনিই জানেন) আয়াতের এ অংশটুকুর দ্বারা একথার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হুযুর আলাইহিস সালাম প্রকৃত পক্ষে যেরূপ বিরাজমান, সেরূপে কেউ তাঁকে জানে না। ‘হাকীকাতে মুহাম্মদীয়া, কে একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন। مفاتح শব্দটি বহুবচন আকারে এজন্য ব্যবহৃত হয়েছে যে, তাঁর প্রত্যেকটি প্রেমময় আচরণ রহমতে ইলাহীর চাবি বিশেষ, তাঁর নূর হচ্ছে নিখিল জগতের চাবিস্বরূপ।
❏হাদীছে উক্ত হয়েছে: كُلُّ الْخَلْقِ مِنْ نُوْرِىْ -সমস্ত মাখলুক আমার নূর থেকে সৃষ্ট।’’
{ক. ইমাম জওজীঃ বযানুল মিলাদুন্নবীঃ ২২ পৃ.
খ. শায়খ আব্দুল গণী নাবলুসীঃ হাদিকাতুল নাদিয়াঃ ২/৩৭৫ পৃ.
গ. শায়খ ইউসূফ নাবহানীঃ জাওয়া হিরুল বিহারঃ ১/২১৯
ঘ. ইমাম জুরকানীঃ শরহুল মাওয়াহেবাঃ ১/৫৪ পৃ. এ হাদিস এবং বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মাচন’ এর ১ম খন্ডের ৩৭৬-৩৮১পৃষ্ঠায় দেখুন-বাহাদুর।}
কিয়ামতের দিন তাঁর সিজদা শাফায়াতের চাবি, বেহেশতের মাঝে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পবিত্র নাম প্রত্যেক নেয়ামতের চাবি এবং বেহেশতে তাঁর পদার্পণ সকলের জন্য বেহেশত উন্মুক্ত হওয়ার চাবি।
(এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমার রচিত গ্রন্থ ‘শানে হাবিবুর রহমান’ দেখুন।)
❏আরও একটি সুক্ষন্ড তাৎপর্যঃ এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, গায়বের চাবিসমূহের রয়েছে আল্লাহ তা’আলার কাছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ চাবি দিয়ে কারো জন্য গায়বের দরজা খোলা হয়েছে কিনা? বা কাউকে কোন চাবি দেয়া হয়েছে কিনা? এর জওয়াব কুরআন হাদীছের মধ্যেই রয়েছে, পর্যালোচনা করুন।
❏কুরআন ইরশাদ করেছে اِنَّا فَتَحْنَللَكَ فَتْحَا مُبِيْنًا অর্থাৎ- আমি (আল্লাহ) আপনার জন্য সুস্পষ্টভাবে খুলে দিয়েছি। কি খুলে দিয়েছেন?
{সূরাঃ ফাতাহ, আয়াতঃ ১, পারাঃ ২৬}
(এ সম্পর্কে হৃদয়গ্রাহী তাৎপর্যপূর্ণ বিবরণ আমার রচিত কিতাব “শানে হাবিবুর রহমান বি আয়াতিল কুরআন” পর্যালোচনা করে দেখুন।)
তালা-চাবিতে বস্তুই সযত্নে রাখা হয়, যা’ খুলে বের করতে হয়; আর যা’ খুলে বের করতে হয় না, তা’ যমীনে পুঁতে ফেলা হয়। এতে বোঝা গেল যে, গায়ব’ তাঁকে দেয়ার ছিল, তাই চাবিতে রাখা হয়েছিল।
❏এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে আছে-
أُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ خَزَائِنِ الْأَرْضِ
-‘‘আমাকে পৃথিবীর যাবতীয় ধনভান্ডারের চাবি সমূহের অর্পণ করা হয়েছে।’’
{ক. খতিব তিবরিযীঃ মিশকাতঃ ৪/৩৫৪পৃ. হাদিসঃ ৫৯৫৮, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন।
খ. বুখারীঃ আস্-সহীহঃ ৬/১২৮ হাদিসঃ ২৯৭৭
গ. মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ১/৩৭১ পৃ. হাদিসঃ ৫২২৬
ঘ. নাসায়ীঃ আস-সুনানঃ ৬/৩ পৃ. হাদিসঃ ৩০৮৭
ঙ. আহমদঃ আল-মুসনাদঃ ২/২৬৪ পৃ.}
এ থেকে বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস সালামকে চাবিও দেয়া হয়েছে, আর তাঁর জন্য দরজাও উন্মুক্ত করা হয়েছে।
(৪) قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ
-‘‘আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান সমূহ ও যমীনে যারা আছেন, তারা গায়ব জানেন না।’’
{সূরাঃ নামল, আয়াতঃ ৬৫, পারাঃ ২০}
তাফসীরকারগণ এ আয়াতের দুটি তাৎপর্য দুটি ভাবার্থ লিখেছেন- সত্ত্বাগতভাবে ‘গায়ব কেউ জানে না বা সমস্ত গায়বও কেউ জানে না।
❏তাফসীরে ‘আলমুয়াজে জলীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে-
مَعْنَاهَ لاَيَعْلَمُ الْغَيْبَ بِلاَدَلِيْلٍ اِلاَّاللهُ اَوْ بِلاَ تَعْلِيْمِ اَوْ جَمِيْعَ الْغَيْبِ
-‘‘এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে বিনা দরীলে বা জ্ঞাত করানো ছাড়া, সম্পূর্ণ গায়ব খোদা ভিন্ন অন্য কেউ জানে না।’’
{ইমাম আহমদ রেযা খাঁনঃ খালিসুল ই’তিকাদঃ ১৫ পৃ.}
❏‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
وَالَغَيَبُ مَالَمْ يَقُمْ عَلَيْهِ دَلِيْلً وَلاَ اُطَلِىَ عَلَيْهِ مَخْلُوْقً
-‘‘গায়ব হলো উভয়ই, যা’র কোন প্রমাণ উপস্থাপিত নেই এবং সৃষ্টিকূলের কাউকে যা’ জ্ঞাত করা হয়নি।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ২/২৪৬ পৃ.}
‘তাফসীরে মাদারিকের’ এ ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল যে, উক্ত মুফাসসিরের পরিভাষায় প্রদত্ত জ্ঞানকে ‘ইলমে গায়ব’ বলা হয় না; কেবল সত্ত্বাগত জ্ঞানকে ইলমে গায়ব বলা হয়। এখন আর কোন সমস্যাই রইলো না। কেননা, যে সব আয়াতে ইলম গায়ব এর অস্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো সত্ত্বাগতভাবে জানা গায়ব সম্পর্কে প্রযোজ্য। এ আয়াতের কিছু আগে আছেঃ
مَامِنْ غَائِبٍ فِى الْاَرْضِ وَلاَفِى السَّمَاءِ اِلاَّفِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ
-‘‘ভূ-মন্ডল ও নভঃমন্ডলে যা’ কিছু অদৃশ্য আছে, তা সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’’ এ আয়াত থেকে বোঝা গেল প্রত্যেকটি ‘গায়ব’ লওহে মাহফুজ ও কুরআনের মধ্যে মওজুদ আছে।
❏‘ফতওয়ায়ে ইমাম নববীতে’ উল্লেখিত আছেঃ
مَامَعْنَى قَوْلِ اللهِ لاَيَعءلَمُ مَنْ فِى السَّمَوَتِ وَاَشْبَاهِ ذَلِكَ مَعَ اَنَّهُ قَدْ عَلِمَ مَافِىْ غَدٍ وَالْجَوَابُ مَعءنَاهُ لاَيَعْلَمُ ذَلِكَ اِسْتَقْلاَلاً وَاَمَّا الْمُعْجِزَاتُ وَالْكَرَا مَاتُ فَحَصَلَتْ بِاِعْلاَمِ اللهِ لاَاِسْتَقْلاَلاًَ
-‘‘কুরআনের আয়াত لاَيَعْلَمُ مَنْ فِى السَّمَوَتِ الخ ও এ ধরনের অন্যান্য আয়াতের কি অর্থ হতে পারে? হুযুর আলাইহিস সালামতো ভবিষ্যতের খবর জানেন। এর উত্তর হলো গায়বকে স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে (সত্ত্বাগতভাবে) কেউ জানে না। তাহলে মু’জিযা ও কারামতের কি তাৎপর্য হবে? এর উত্তর হবে, এতে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক অবহিত করার ফলেই এ জ্ঞান অর্জিত, সত্ত্বাগত বা স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে নয়।’’
{ইমাম নববীঃ ফাতওয়ায়ে ইমাম নববীঃ ১৭৩ পৃ.}
❏ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহঃ) ‘ফাতওয়ায়ে হাদীছিয়া’ বলেনঃ
مَاذَكَرْنَاهُ فِى الْاَيَاتِ صَرَّحَ بِهِ النَّوْوِىُّ فِىْ فَتَاوَاهُ فَقَالَ لاَيَعْلَمُ ذَلِكَ اِسْتِقْلاَلاً وَعِلْمَ اِحَاطَةٍ بِكُلِّ الْمَعْلُوَمَاتِ
-‘‘আমি এ আয়াত সম্পর্কে যা কিছু বলেছি, ইমাম নববী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর ফাত্ওয়ায়ে এটা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, গায়ব সম্পর্কে স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে ও আল্লাহর জ্ঞাত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে কেউ জ্ঞাত নয়।’’
{আল্লামা ইবনে হাজার মক্কীঃ ফতোয়ায়ে হাদীসিয়্যাহঃ ১/২২৩ পৃ.}
❏ইমাম খিফ্ফাজী (রহ.) তার ‘নাসিমুর রিয়াদ্বে’ লিখেন-
هَذَا لاَيُنَا فِى الْاَيَاتِ الدَّالَّةِ عَلَى اَنَّهُ لاَيَعْلَمُ الْغَيْبَ اِلاَّ اللهُ فَاِنًَّ الْنَفِىَ عِلْمًا مِنْ غَيْرِ وَاسِطَةٍ اَمَّا اِطِّلاَعُهُ عَلَيْهِ بِاِعْلاَمِ اللهِ فَاَمْرٌُ مُتَحَقَّقٌُ
-‘‘এ বক্তব্যটি ওই সমস্ত আয়াতের পরিপন্থী নয়, যেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, খোদা ছাড়া আর কেউ গায়ব জানেনা। কেননা, সেই আয়াত সমূহে মাধ্যমবিহীন জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে, কিন্তু খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের ফলশ্রুতিস্বরূপ জানার বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত।’’
{আল্লামা শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসিমুর রিয়াদঃ ৩/১৫০ পৃ.}
যদি উক্ত আয়াতের এ ভাবার্থ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে এ আয়াতটি বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের মতের বিপরীত হবে। কেননা, তারাও হুযুরের আংশিক ইলমে গায়ব স্বীকার করেন, অথচ এ আয়াতে সম্পূর্ণরূপে তার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। অধিকন্তু তারা শয়তান ও মৃত্যুর ফিরিশতাকেও ইলমে গায়বের অধিকারী বলে স্বীকার করেন।
(‘বারাহীনে কাতিয়া’ গ্রন্থে ৫০ পৃষ্ঠা দেখুন।)
তারা এ আয়াতের কি মর্মার্থ গ্রহণ করবেন?
❏কুরআন শরীফে আছে اِنِ الْحُكْمُ اِلاَّ لِلَّهِ. -‘‘আল্লাহ ব্যতীত কারো হুকুম করার অধিকার নেই।’’
{সুরা ইউসুফ, আয়াত.৪০}
❏অন্যত্র আছে لَهُ مَافِى السَّمَوَاتِ وَمَافِى الْاَرْضِ অর্থাৎ- আসমান যমীনে যা’ কিছু আছে সব কিছু আল্লাহরই।
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১৭১, পারাঃ ৬}
❏আর এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا -‘‘আল্লাহ তা’আলাই সাক্ষীরূপে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৭৯, পারাঃ ৫}
❏অন্য এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে وَكَفَى بِاللهِ وَكِيْلاّ -‘‘আল্লাহ তা’আলাই ওকীল হিসেবে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৮১, পারাঃ ৫}
❏আরো এক জায়গায় আছে وَكَفَى بِاللهِ حَسِيْبًا -‘‘আল্লাহ তা’আলাই হিসাব গ্রহণকারী রূপে যথেষ্ট।’’
{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৬, পারাঃ ৪}
উলিখিত আয়াত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, রাজত্ব, মালিকানা, সাক্ষ্য, কার্যনির্বাহের ক্ষমতা, হিসাব গ্রহণ ইত্যাদি আল্লাহরই জন্য ‘খাস’ (বৈশিষ্ট্য সূচক গুণাবলী।) কিন্তু এখন ইসলামী রাজ্যের বাদশাহকে শাসক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ দ্রব্যসামগ্রীর মালিক, বিধর্মীদেরকে ওকীল ও হিসাব
নিকাশকারী এবং সাধারণ লোকদেরকে মামলা মুকাদ্দমায় সাক্ষীরূপে সবাই স্বীকার করেন। এটা কেমনে হয়? এটা শুধু এজন্য যে, উলিখিত আয়াত সমূহে রাজত্ব, মালিকানা ইত্যাদি দ্বারা যথার্থ ও সত্ত্বাগত গুণের কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। আর, এসব গুণাবলী অন্যান্যদের বেলায় খোদা প্রদত্ত হিসেবে স্বীকৃতি হয়েছে। অনুরূপভাবে গায়ব সম্পর্কিত আয়াতের ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণ অপরিহার্য। অর্থাৎ আয়াতে যথার্থ ও সত্ত্বাগত জ্ঞানের অস্বীকৃতি এবং খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে।
(৫)وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِينٌ
-‘‘আমি তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কবিতা আবৃত্তি শিক্ষা দিইনি, এবং তা’ তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্মান-প্রতিপত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে অশোভনীয়ও বটে। এটা উপদেশ ও সুস্পষ্ট কুরআন বৈ আর কিছু নয়।’’
{সূরাঃ ইয়াসীনঃ আয়াতঃ ৬৯, পারাঃ ২৩}
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের তিনটি মর্মার্থ ব্যক্ত করেছেন।
প্রথমতঃ علم ‘ইলম’ শব্দের কয়েকটি অর্থ আছে; যেমন- জানা, প্রতিভা চর্চা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এখানে এ শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, আমি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কে কবিতা আবৃত্তির প্রতিভা দিইনি। একথা নয় যে, তাঁকে ভাল-মন্দ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ কবিতাবলী যাচাই করার প্রতিভা দিইনি।
দ্বিতীয়তঃ, কবিতার দু’ধরনের অর্থ আছে। একঃ ছন্দোবদ্ধ শব্দের মিল সম্বলিত কথা (গযল)। দুইঃ মিথ্যা মনগড়া ও কাল্পনিক কথাবার্তা। এ আয়াতের এ ‘শের’ শব্দটি দ্বিতীয় প্রকারের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমি তাঁকে মিথ্যা, মনগড়া ও কাল্পনিক কথাবার্তা শিক্ষা দিইনি। তিনি যা কিছু বলেন, তা সত্য।
তৃতীয়তঃ ‘কবিতা’ বলতে এখানে সংক্ষিপ্ত ও রহস্যাবৃত কথাবার্তাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমি তাঁকে প্রত্যেক কিছুর বিস্তারিত জ্ঞান দান করেছি, ধাঁধাঁপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত ও দুর্বোধ্য কথাবার্তা শিখাইনি।
❏কুরআনই ইরশাদ করেন- وَتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْئٍ অর্থাৎ- এ কুরআন বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত। علم শব্দটি এখানে প্রতিভা অর্থে ব্যবহৃত। কুরআন করীম ইরশাদ করছে وَعَلَّمْنَهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لٌُكَمْ، -‘‘আমি তাঁকে তোমাদের জন্য পরিধেয় সরঞ্জাম প্রস্তুতের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছি।’’
{সূরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৮০, পারাঃ ১৭}
❏প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ দায়লামী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তার ফিরদাউস কিতাবে হযরত জাবির (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন- عَلِّمُوْا بَيْنَكُمْ الرَّمْىَ. -‘‘তোমরা নিজ সন্তান-সন্ততিদেরকে তীরান্দাযী শিক্ষা দাও।’’
{ইমাম দায়লামীঃ ফিরাউস বিমাহিরুল খিতাবঃ ৩/১১ হাদিসঃ ৪০০৮}
❏‘তাফসীরে রূহুল বায়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা লিখা হয়েছেঃ
والْاَصَّحُّ اَنَّهُ كَانَ لاَيُحْسِنَهُ وَلَكِنْ كَانَ يُمَيِّزُ جَيِّدَ الشِّعْرِ وَرَدِيَّهُ
-‘‘সর্বাধিক সঠিক কথা হলো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সুন্দরভাবে কবিতা আবৃত্তি করতেন না, কিন্তু ভাল-মন্দ কবিতার পার্থক্য নির্ণয় করে ফেলতেন।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৩০৬ পৃ.}
❏তাফসীরে রূহুল বয়ানে সে একই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখিত আছেঃ
اِنَ الْمُحَرَّمَ عَلَيْهِ اِنَّمَا هُوَ اِنْشَاءُ الشِّعْرِ
‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা রচনা নিষিদ্ধ ছিল।’’ এখানে شعر শে’র শব্দের অর্থ হলো মিথ্যা বর্ণনা। মক্কার কাফিরগণ বলতো যে, কুরআন শরীফ হলো কবিতা, আর হুযুর আলাইহিস সালাম হলেন কবি بَلْ هُوَ شَاعِرٌُ (তিনি বরঞ্চ একজন কবি) এ‘শে’র শব্দ বলতে তারা মিথ্যা বর্ণনাকে বোঝাতো। তাই এদের এ অবান্তর উক্তি খন্ডন করার জন্য এ আয়াত নাযিল করা হয়েছে।
❏বলা হয়েছেঃ
ان هُوَ الاَّذِكْرٌُ وَقُرْآنَّ مٌُبِيْن
অর্থাৎ- এটা উপদেশ ও উজ্জ্বল কুরআন বৈ অন্য কিছু নয়।
{সূরাঃ ইয়াসীন, আয়াতঃ ৬৯, পারাঃ ২৩}
উক্ত আয়াতে যদি شعر বলতে ছন্দোবদ্ধ পদ্যাকারে রচিত কথাই বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে এ আয়াতের শেষোক্ত অংশের সাথে ওই একই আয়াতের প্রথমোক্ত অংশের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
❏‘তাফসীরে মাদারিকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
اَىْ مَاعَلٌُمْنَا النَّبِىَّ عَلَيهِ السَّلاَمُ قَوْلَ الشِّعْرِ وَمَا عَلَّمْنَاهُ بِتَعْلِيْمِ الْقُرْاَنِ الشِّعْرَ عَلىَ مَعْنَى اَنَّ الْعُرْاَنَ لَيْسَ بِشِعْرٍ
-‘‘আমি নবী আলাইহিস সালামকে কবিতা আবৃত্তি শিক্ষা দিইনি, বা তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিতে গিয়ে কবিতা শিখায়নি। আসল কথা হলো ‘কুরআন কল্পনা প্রসূত কবিতা নয়।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিক কঃ ২/৪০৪ পৃ.}
❏‘তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছেঃ
وَلمَّا نَفَى اَنْ يُّكُوْنَ الْقُرْاَنُ مِنْ جِنْسِ الشِّعَرِ قَالَ اللهُ تَعَالَى اِنْ هُوَاِلاَّ ذِكْرٌُ وَّقُرْ اَنٌُ مُّبِيْنٌُ
-‘‘যখন আল্লাহ তা’আলা তাদের একথা ‘কুরআন কাব্য জাতীয় উদ্ভট চিন্তাধারা’ খন্ডন করে দিল, তখন ইরশাদ করলেন- এটা উপদেশ ও উজ্জ্বল কুরআন বৈ অন্য কিছু নয়।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১৩ পৃ.}
❏তাফসীরে খাযেনে আরও উল্লেখিত আছেঃ
قِيْلَ اِنَّ كُفَّارَ قُرَيْشٍ قَالُوْا اِنَّ مُحَمَدًا شَاعِرٌُ وَمَايَقُوْلُهُ شِعْرٌُ فَاَنْزَلَ اللهُ تُكْذِيْبًا لَّهُمْ وَمَاعَلَّمْنُهُ الشِّعْرَ
-‘‘বর্ণিত আছে যে, কুরাইশ বংশের কাফিরগণ বলে ছিল যে, হুযুর আলাইহিস সালাম হলেন একজন কবি এবং তিনি যা কিছু বলেন (কুরআন) তা’ হলো কবিতা। তাদের এ কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে- وَمَاعَلَّمْنُهُ الشِّعْرَ الخ (আমি তাঁকে ‘শে’র’ শিখাইনি)।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১২ পৃ.}
বিঃ দ্রঃ- উল্লেখ্য যে এখানে বিরুদ্ধমতাবলম্বীনগণ প্রশ্ন করে থাকেন যে, বর্ণিত আছে যে, নবী আলাইহিস সালামের পবিত্র যবান কবিতা পাঠের উপযোগী ছিল না। অর্থাৎ- তিনি কোন কবিতা পাঠ করতেই শব্দ বিন্যাস, ছন্দ ইত্যাদির বিকৃতি ঘটতো।
❏যেমন, তাফসীরে খাযেনেই বর্ণিত আছেঃ
اَىْ مَايَسْهَلُ لَهُ ذَلِكَ وَمَا يُصْلِحُ مِنْهُ بِحَيْثُ لَوْ اَرادَ نَظْمَ شِعْرٍ لَمْ يَتَاتَّ لِذَلِكَ
-‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা আবৃত্তি তত সহজ ছিল না, এবং যথাযথভাবে আবৃত্তি করতে পারতেন না। যদি কখনও পদ্যাকারে কবিতা আবৃত্তি করার ইচ্ছা করতেন, এটা তাঁর জন্য সম্ভবপর হতো না।’’
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ৪/১২ পৃ.}
❏তাফসীরে মাদারিকে আছেঃ
اَىْ جَعَلْنَاهُ بِحَيْثُ لَوْ اَرَادَ قِرْءَةَ شِعْرٍ لَّمْ يَتَسَهَّلْ
-‘‘আমি তাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছি যে তিনি কবিতা পাঠের ইচ্ছা করলেও যেন তাঁর জন্য তা সহজ না হয়।’’
{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিককঃ ১/৪০৫ পৃ.}
❏‘তাফসীরে কবীরে’ আছেঃ
مَا يَتَسَهَّلُ لَهُ حَتَّى أَنَّهُ إِنْ تَمَثَّلَ بَيْتَ شِعْرٍ سُمِعَ مِنْهُ مُزَاحَفًا
-‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জন্য কবিতা সহজ ছিল না এমনকি তিনি কোন কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে চাইলে, তা’ ভাঙ্গা ভাঙ্গা ও বেসুরে শোনা যেত।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কবীরঃ ৯/৩০৪-৩০৫ পৃ.}
উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর হলো এ যে, কাব্য জ্ঞান ও কাব্য আবৃত্তির জ্ঞান এক নয়। অনেক বড় বড় কবিও সূর দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন না, আবার অনেক প্রশংসাসূচক কবিতা পাঠক ও কাওয়ালও কাব্য জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ থেকেও কাব্য আবৃত্তির পূর্ণ সামর্থ রাখেন। আপনি রুটি তৈরী করতে জানেন না, কিন্তু রুটি ভাল কি মন্দ, পুরু কি পাতলা ইত্যাদি বিষয় ভাল করেই বুঝতে পারেন।
আপনাদের উক্ত ভাষ্য থেকে একটুকুই বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস সালামের কবিতা পাঠের প্রতিভা বা কোন রূপ অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু একথা নয় যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কবিতার গুণাগুণ বিচারের জ্ঞান ছিল না। আমরাও তো তাই বলছি- কতেক কবিতা তাঁর পছন্দ এবং কতেক অপছন্দ ছিল।
❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ সেই একই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
كَانَ اَحَبَّ الْحَدِيْثِ اِلَيْهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ الشِّعْرُ وَاَيْضًا كَانَ اَبْغَضَ الْحَدِيْثِ اِلَيْهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ الشِّعْرُ
-‘‘হুযুর (আলাইহিস সালামের) কাছে কবিতা খুবই পছন্দনীয় ছিল তবে কোন কোনটি আবার অতীব না পছন্দও ছিল।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৫০৬ পৃ.}
আবার অনেক হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কোন কোন কবির কবিতামালা পাঠ করতেন এবং এগুলোর ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। সেরূপ কবিতার একটি পংক্তি হলো اَلاَكُلُّ شَيْئٍ مَاخَلاَ اللهُ بَاطِلٌُ. অর্থাৎ- সাবধান! আল্লাহ ছাড়া যা’ কিছু আছে, সবই বাতিল। যদি তাঁর কবিতা সম্পর্কে ভালমন্দ জ্ঞান না থাকতো, তাহলে তার প্রশংসাই বা করতেন কিরূপে? কুরআনে উল্লেখিত কবিতা বলতে সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট অর্থপূর্ণ উক্তির বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে।
❏তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
قاَل َالشَّيْخُ الْاَكْبَرُ اِعْلَمْ اَنَّ الشِّعْرَ مَحَلٌُ لِلْاِجْمَالِ وَاللَّغْزِ وَالتَّوْرِيَّةِ اَىْ مَارَمَزْنَا مُحَمَّدًا عَلَيْهِ السَّلاَمُ شَيْئًا وَلاَ اَلْغَزْنَا وَلاَ خَطَبْنَاَهُ بِشَيْئٍ وَنَحْنُ نُرِيْدُ شَيْئًا وُلاَجعَلَنْاَ لَهُ الْخِطَابَ حَيْثُ لَمْ يَفْهَمْ
-‘‘শায়খ আকবর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেছেন, একথা জানতে হবে যে, কবিতা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট, ধাঁধাঁ, সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পূর্ণ উক্তির সহিত ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব উক্ত আয়াতের অর্থ হবে, আমি প্রিয় নবীর কাছে কোন কিছু ইশারা ইঙ্গিতে প্রকাশ করিনি এবং এ রকমও করিনি যে একটি কথার ইচ্ছা করে অপর একটি বিষয় প্রকাশ করেছি। তাঁর সাথে এমন কোন সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট কথাও বলিনি, যা’ তাঁর বোধগম্য হয় না।’’
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৭/৫০৪ পৃ.}
(৬) مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ
-‘‘ওই সকল নবীগণের কারো কারো অবস্থা আপনাদের নিকট ব্যক্ত করেছি এবং অনেকের অবস্থা ব্যক্ত করেনি।’’
{সূরাঃ গাফির, আয়াতঃ ৭৮, পারাঃ ২৪}
তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের কয়েকটি প্রায়োগিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথমতঃ এখানে সকল নবীগণের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান দান করার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়নি বরং কুরআন করীমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনার বিষয়টির অস্বীকৃতিই নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন কোন নবীর ঘটনাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ আয়াতে সুবিস্তৃতি বর্ণনার অস্বীকৃতি বোঝানো হয়েছে, তবে সবার সামগ্রিক, সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ প্রকাশ্য ওহীতে সবার কথা উল্লেখ করা হয়নি, অপ্রকাশ্য ওহীতে সবার কথা বলা হয়েছে।
❏‘তাফসীরে সাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
اِنَّ النَّبِىُّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَخْرُجُ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى عَلِمَ جَمِيْعِ الْاَنْبِيَاءِ تَفْصِيْلًا كَيْفَ لاَوَهُمْ مُخْلَقُوْنَ مِنْهُ وَخَلَّفَهُمْ لَيْلَةَ الْاِسْرَاءِ فِىْ بَيْتِ الْمُقَدَّسِ وَلَكِنَّهُ الْعِلْمُ الْمَكْنُوْنُ وَاِنَّمَا تَرَكَ بَيَانَ قَصَصِهِمْ لِاَمَّتِهِ رَحْمَةً بِهِمْ فَلَمْ يُكَلِّفُهُمْ اِلاَّ بِمَا كَانُوْا يُطِيْقُوْنَ
অর্থাৎ- হুযুর আলাইহিস সালাম সকল নবীগণের বিস্তারিত তথ্য না জেনে পৃথিবী থেকে তাশরীফ নিয়ে যান নি। কেননা, নবীগণ সবাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নূর থেকেই সৃষ্ট হয়েছেন এবং মিরাজের পবিত্র রাতে ‘বায়তুল মুকাদ্দিসে’ সবাই তাঁর মুক্তাদী হয়েছিলেন। কিন্তু এটা হলো গোপনীয় বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান। আর ঐ সকল নবীগণের বিস্তারিত বিবরণ উম্মতের প্রতি মেহেরবাণী স্বরূপ বাদ দিয়েছেন। তাদেরকে সাধ্যাতীত কষ্ট দেননি।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৫/১৯৭ পৃ.}
❏মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘মিরকাতের’ প্রথম খন্ডের ৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছেঃ
هَذَا لاَيُنَا فَىْ قُوْلَهُ تَعَالَي مِنْهُمْ مَنْ لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ لِاَنَّ الْمَنْفِىَّ هُوَ التَّفْصِيْلُ وَالثًابِتْ هُوَالْاِجْمَالُ اَوِالنَّفِىُّ مُقَيِّدٌُ بِالْوَحِى الْجَلِىِّ وَالثَّبُوْتُ مُتَحَقَّقٌُ بِالْوَحْىِ الْخَفِىِّ
অর্থাৎ- এ বক্তব্য আয়াত مِنْ هُمْ مَنْ لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ এর সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা, আয়াতে অস্বীকৃতি বিষয়টি হলো সংক্ষিপ্ত ভাষায় ব্যক্ত তথ্যসমূহ অথবা অস্বীকৃতি হলো প্রকাশ্য ওহী (কুরআন) মারফত বর্ণনা করার বিষয়টির, আর স্বীকৃতি হলো অপ্রকাশ্য ওহীর (হাদীছ) মাধ্যমে বর্ণনা করার ব্যাপারটির।
❏এ প্রসঙ্গে কুরআন ইরশাদ করেছেঃ
وكُلاَّ نَقْصُىْ عَلَيْكَ مِنْ اَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَانُثَبُتَ بِهِ فُؤادَكَ
অর্থাৎ- আমি আপনাকে সমস্ত রাসূলের কাহিনী শুনাই, যাতে আপনার হৃদয়ে স্থিতি আসে।
{সূরাঃ হুদ, আয়াতঃ ১২০, পারাঃ ১২}
(৭)يَوْمَ يَجْمَعُ اللهُ الرُّسُلَ فَيَقُوْلُ مَاذَا اُجِبْتُمْ قَالُوْا لاَعِلْمَ لَنَا اِنَّكَ اَنْتَ عَلاَّم الْغُيُوْبِ
অর্থাৎ- যেদিন আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণকে একত্রিত করে বলবেন, আপনারা (স্ব-স্ব উম্মতের পক্ষ হতে) কি উত্তর পেয়েছেন? আরয করবেন, আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনিই যাবতীয় অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত।
{সূরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ১০৯, পারাঃ ৭}
তাফসীরকারগণ এ আয়াতের তিন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথমটা হলো, আপনার জ্ঞানের মুকাবিলায় আমাদের কোন জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়টা হলো আদব ও সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এ ধরনের বিনীত নিবেদন করা হবে। তৃতীয়টা হলো কিয়ামতের মাঠে যখন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সকলের মুখ থেকে ‘নফসী’ ‘নফসী’ রব উঠবে, তখনই নবীগণ এরূপ বলবেন। পরে অবশ্য আরয করবেন; আমরা নিজ নিজ উম্মতের কাছে আপনার নির্দেশাবলী প্রচার করেছি, কিন্তু তারা মানেনি। কাফিরগণ বলবে, আমাদের কাছে আপনার নির্দেশাবলী পৌঁছেনি। এ ব্যাপারে উম্মতে মুস্তাফা আলাইহিস সালাম নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন।
❏তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
فَعَلى هَذَا الْقَوْلِ اِنَّمَا نَفُوا الْعِلْمَ عَنْ اَنْفُسِهِمْ وَاِنْ كَانُوْا عُلَمَاءَ لِاَنَّ عِلْمَهُمْ صَارَ كَلاَ عِلْمٍ عِنْدَ اللهِ
অর্থাৎ- এ উক্তির দ্বারা নবীগণ নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবেন, যদিও বা তাঁরা সম্যকরূপে সবকিছুই জানবেন। এরূপ উক্তি করার কারণ হবে আল্লাহর জ্ঞানের সামনে তাদের জ্ঞান অজ্ঞানতার মতই প্রতিভাত হবে।
{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেন, ২/৮৯ পৃ.}
❏‘তাফসীরে মাদারিকে’ আছেঃ
قَالُوْا ذَلِكَ تَاَدُّبًا اَىْ عِلْمُنَا مَعَ عِلْمِكَ فَكَاَنَّهُ لاَعلِمْ َلَنَا
অর্থাৎ- ওই সকল নবীগণ এরূপ উক্তি করবেন মহান আল্লাহর প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে। অর্থাৎ তাঁর বলবেন, প্রভু হে! আমাদের জ্ঞান তোমার অসীম জ্ঞানের সামনে অজ্ঞানতায় পর্যবসিত হয়েছে। সুতরাং, আমাদের যেন কোন জ্ঞানই নেই।
{ইমাম নাসাফী, তাফসীরে মাদারিক, ১/১৫০ পৃ.}
❏‘তাফসীরে কবীরে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
اِنًَّ الرُّسُلَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ كَمَا عَلِمُوْا اَنَّ اللهَ عَالِمٌُ لاَيَجْهَلْ حَلِيْمُ لاَيَسْفَهُ عَادِلٌُ لاَيَظْلِمُ عَلِمُوْا اَنَّ قَوْلَهُمْ لاَيُفِيْدُ خَيْرًا وَّلاَيَدْفَعُ شَرًّا فَالْاَدَبُ فِى السُّكُوْتِ وَتَفْوِيْضِ الْاَمْرِ اِلَى اللهِ وَعَدَلِهِ فَقَالُوْا لاَعِلْمَ لَنَا
অর্থাৎ- নবীগণ যখন জানেন যে, আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানী, অজ্ঞ নন, প্রজ্ঞাময় ও ধৈর্যশীল, নির্বোধ নন, ন্যায়পরায়ণ, অত্যাচারী নন, তখন তাঁরা বুঝে নিবেন যে, তাঁদের কোন কথা দ্বারা কোন মঙ্গল হবে না, কিংবা কোনরূপ বিপদ মুক্তিও হবে না। এমতাবস্থায় আদব রক্ষা ও সম্মান প্রর্দশনের একমাত্র উপায় নীরব থাকা ও বিষয়টি আল্লাহর ন্যায়নীতির উপর ছেড়ে দেয়া। তাই তাঁরা আরয করবেন আমাদের কোন জ্ঞানই নেই।
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী, তাফসীরে কবীর, ৩/৪৬৭ পৃ.}
❏‘তাফসীরে বায়যাবীতে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছেঃ
وَقِيْلَ الْمَعْنَى لاَعِلْمَ لَنَا اِلَى جَنْبِ عِلْمِكَ
অর্থাৎ- বলা হয়েছে যে, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে- প্রভু হে! আপনার জ্ঞানের মুকাবিলায় আমাদের কোন জ্ঞান নেই।
{ইমাম বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভী}
❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছেঃ
اِنَّ هَذَا الْجَوَابَ يَكُوْنُ فِىْ بَعْضِ مَوَاطِنِ الْقِيَمَةِ وَتَرْجِعُ عُقُوْلَهُمْ اِلَيْهِمْ فَيَشْهََدُوْنَ عَلَى قَوْمِهِمْ اَنَّهُمْ بَلَّغَوْا الرِّسَالَةَ وَاَنَّ قَوْمَهُمْ كَيْفَ رَدُّوْا عَلَيْهِمْ
অর্থাৎ- এ ধরনের উত্তর কিয়ামতের মাঠে কোন এক স্থানে দেয়া হবে। অতঃপর ধীর স্থির হয়ে নবীগণ (আলাইহিস সালাম) নিজ নিজ উম্মত সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন আমরা রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছিলাম আর আমাদের উম্মতগণ আমাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল (সংক্ষিপ্ত)।
{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/৫৪৯ পৃ.}
(৮)وَمَا اَدْرِىْ مَا يُفْعَلُ بِىْ وَلاَبِكُمْ
অর্থাৎ- আমি জানিনা যে আমার সাথে কিরূপ আচরণ করা হবে আর তোমাদের সাথেই বা কিরূপ আচরণ করা হবে।
{সূরাঃ আহক্বাফ, আয়াতঃ ৯, পারাঃ ২৬}
বিরুদ্ধমতাবলম্বীগণ এ আয়াতকে প্রামাণ্য দলীলরূপে গ্রহণ করে নিজেদের মতবাদের সমর্থন পেশ করে থাকেন। তারা বলেন, হুযুর আলাইহিস সালামের নিজের খবর নেই, অন্য কারো খবর রাখার তো প্রশ্নই উঠে না। কেননা, তিনি এ বিষয়ে জ্ঞাত নন যে, কিয়ামতের ময়দানে আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে। কিন্তু তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি মত প্রকাশ করেছেন-
প্রথমতঃ এ আয়াত مَااَدْرِىْ দ্বারা ‘দিরায়তের’ই অস্বীকৃতি বোঝানো হয়েছে; ইলমের নয়। অনুমান ও আন্দাজের উপর ভিত্তি করে কোন কিছুর জ্ঞানকে ‘দিরায়ত’ বলা হয়। (এই ‘দিরায়ত’ থেকে ‘আদরি’ শব্দটি গঠিত হয়েছে।) অর্থাৎ এ কথা মনে করো না যে, আমি ওহী ব্যতীত অনুমানের ভিত্তিতেই এ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, বরং ওহীর মাধ্যমেই সবকিছু জেনেছি।
দ্বিতীয়তঃ এ আয়াতটি হুযুর আলাইহিস সালামকে কিয়ামতের সাথে সংশিষ্ট বিষয়ে অবহিত করার আগেই নাযিলকৃত। সুতরাং, এটা রহিত (মানসুখ) বলে গণ্য।
❏‘তাফসীরে সাবী’তে এর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
مَاخَرَجَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى عَلَّمَهُ اللهُ فِى الْقُرْاَنِ مَايَعْمَلُ بِهِ وَبِالْمُؤْ مِنِيْنَ فِى الدُّنْيَا وَالْاَخِرَةِ اِجْمَالاًوَّتَفْصِيْلاً
অর্থাৎ- হুযুর আলাইহিস সালাম এ ধরাধাম থেকে বিদায় গ্রহণ করেন নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মাধ্যমে তাঁর সাথে ও মুমিনগণের সাথে দুনিয়া ও আখিরাতে কি ধরনের ব্যবহার করা হবে, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে ও বিস্তারিতভাবে অবহিত করেছেন।
{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৫/২৭৮ পৃ.}
━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।
No comments